হস্তিবাহিনীর উপর যেভাবে আযাব এলো
এভাবে কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর হঠাৎ সমুদ্রের দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে এলো। প্রত্যেকটি পাখির মুখে একটি ও দুই পায়ে দুটি করে পাথর ছিল।
ওয়াকিদী রহ. বর্ণনা করেন, পাখিগুলো এত আশ্চর্য ধরনের ছিল, ইতোপূর্বে কখনোই ঐ ধরনের পাখি দেখা যায়নি। সেগুলো আকৃতিতে কবুতরের চেয়ে একটু ছোট, লাল পাঞ্জাযুক্ত ছিল। এদের প্রত্যেক পাঞ্জা ও মুখে একটি করে কাঁকর-পাথর ছিল।
পাখিগুলো হঠাৎ করে এসে আবরাহার সৈন্যদের মাথার উপর শূন্যে অবস্থান গ্রহণ করলো এবং গোটা বাহিনীর উপর পাথরকুচির বৃষ্টি বর্ষণ শুরু করলো। এই কংকর যার শরীরে পড়লো, সাথে সাথে তার শরীর বিগলিত হয়ে মাটিতে প্রবিষ্ট হয়ে গেল।
এই ভয়ানক শাস্তি দেখে সমস্ত হাতি দৌড়ে পালিয়ে গেল। কেবল একটি হাতি সেখানে থেকে গিয়েছিল। সেটাও কংকরের আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেল।
সকল সেনাসদস্য ঐ স্থানে ধ্বংস হয়নি, বরং তাদের অনেকে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করলে, রাস্তায়ই মরতে থাকে এবং জমিনে লুটিয়ে পড়তে থাকে।
আবরাহা বাহিনীর ধ্বংসের বিবরণ রেওয়ায়েতে এভাবে এসেছে,
عَنْ عُبَيْدِ بْنِ عُمَيْرٍ قَالَ : لَمَّا اَرَادَ اللهُ اَنْ يَّهْلِكَ اَصْحَابَ الْفِيْلِ بَعَثَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا اَنْشِئَتْ مِنَ الْبَحْرِ اَمْثَالَ الْخَطَاطِيْفِ كُلُّ طَيْرٍ مِّنْهَا يَحْمِلُ ثَلَاثَةَ اَحْجَارٍ مُجَزَّعَةً حَجَرَيْنِ فِىْ رِجْلَيْهِ وَحَجَرًا فِىْ مِنْقَارِه قَالَ فَجَاءَتْ حَتّٰى صَفَّتْ عَلٰى رُؤُوْسِهِمْ ثُمَّ صَاحَتْ وَاَلْقَتْ مَافِىْ اَرْجُلِهَا وَمَنَاقِيْرِهَا فَمَا يَقَعُ حَجَرٌ عَلٰى رَاْسِ رَجُلٍ اِلَّاخَرَجَ مِنْ دُبُرِه وَلَايعق عَلٰى شَىْءٍ مِّنْ جَسَدِه اِلَّاخَرَجَ مِنَ الْجَانِبِ الْاٰخَرِ وَبَعَثَ اللهُ رِيْحًا شَدِيْدَةً فَضَرَبَتِ الْحِجَارَةَ فَزَادَهَا شِدَّةً فَاَهْلَكُوْا جَمِيْعًا (التفسير للامام ابن كثير)
হযরত উবাইদ ইবনে উমাইর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা যখন ‘আসহাবে ফীল’কে ধ্বংস করার ইচ্ছা করেন, তখন সমুদ্র থেকে তাদের উপর কবুতর ছানার ন্যায় ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি প্রেরণ করেন। সেগুলোর প্রত্যেকটি পাখি মুখে একটি এবং দুই পায়ে দুটি করে কাঁকর-পাথর নিয়ে আসে। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর পাখিগুলো সারিবদ্ধভাবে আবরাহা বাহিনীর মাথার উপর অবস্থান নিয়ে চিৎকার করে আওয়াজ দেয় এবং তাদের মুখ ও দুই পায়ের পাথর নিক্ষেপ করে। পাথরগুলো আবরাহার সৈন্যদের মাথায় বিদ্ধ হয়ে পিছনের রাস্তা দিয়ে বের হয়ে যায় এবং শরীরের এক প্রান্তে প্রবেশ করে অপর প্রান্ত দিয়ে বের হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলা প্রস্তর নিক্ষেপের সাথে সাথে তাদের উপর প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ও প্রেরণ করেন। এই ঝড় উক্ত প্রস্তরের গায়ে আঘাত হেনে তার গতির প্রচন্ডতা তীব্রভাবে বাড়িয়ে দেয় এবং এর দ্বারা তাদের উপর কঠিন গজব নিপতিত হয়ে তারা সকলে ধ্বংস হয়ে যায়। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)
বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক ও ইকরিমা রহ. বর্ণনা করেন, ঐ পাথরকুচির স্পর্শ লাগলেই হস্তি বাহিনীর সৈন্যদের দেহে বসন্ত রোগ উদ্ভূত হয়ে যেত। আরব দেশগুলোতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব এই বছরই সর্বপ্রথম দেখা দেয়।
রইসুল মুফাসসিরীন আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেন, যার উপর এই পাথরকুচি পড়তো, সাথে সাথে তার শরীরে ভয়ানক চুলকানি শুরু হয়ে যেত। এই চুলকানির ফলে চামড়া ফেটে যেত, গোশত খসে পড়ত এবং অস্থি বের হয়ে আসতো।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর অন্য বর্ণনামতে, এই প্রস্তরের আঘাতে শরীরের গোশত ও রক্ত পানির মতো ঝরতে শুরু করতো, যার ফলে হাড্ডি বের হয়ে আসতো। স্বয়ং আবরাহারও এই অবস্থা দেখা দেয়। তার শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে খসে পড়ে যেতে থাকে। তার শরীরের যেখানেই পাথর খণ্ড পড়লো, সেখান থেকেই রক্ত ও পুঁজ প্রবাহিত হতে লাগলো। এই অবস্থায় তাকে ইয়ামানের রাজধানী সানআয় নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে সে ছটফট করতে করতে অত্যন্ত করুণ অবস্থায় মারা গেল।
আবরাহার মাহমুদ নামক হাতির দুইজন চালক মক্কা মুকাররমায় রয়ে গিয়েছিল। তারা অন্ধ ও বিকলাঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। আয়েশা সিদ্দিকা রা. থেকে বর্ণনা করে বলেন, আমার বড় বোন হযরত আসমা বিনতে আবু বকর রা. বলেন, আমি ঐ ল্যাংড়া দুটোকে ভিক্ষা করতে দেখেছি।
হস্তি বাহিনীর এ ঘটনা সম্পর্কে সূরা ফীলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে ইরশাদ করা হয়েছে,
اَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِاَصْحَابِ الْفِيْ
আপনি কি দেখেননি, আপনার রব হস্তি বাহিনীর সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছেন? এখানে প্রশ্ন হয় যে, اَلَمْ تَرَ (আপনি কি দেখেননি) বলা হয়েছে। অথচ এটা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের পূর্বেকার ঘটনা। কাজেই তার সেই ঘটনা দেখার প্রশ্নই উঠে না। এই প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, উক্ত ঘটনা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ ও বর্ণনা তখন এতো ব্যাপক ও বিস্তৃত ছিল, এ ব্যাপারে কারো সন্দিহান হওয়ার কোন অবকাশ ছিল না। আর যে ঘটনা এরূপ নিশ্চিত যে, তা ব্যাপকভাবে প্রত্যক্ষ করা হয়, সেই ঘটনার জ্ঞানকেও দেখা বলে ব্যক্ত করা হয়। যেন এটা চাক্ষুষ ঘটনা। তা ছাড়া ঘটনার কিছু প্রভাব পরবর্তীতেও দেখা গেছে। যেমন, হযরত আসমা রা.-এর দুজন হস্তি চালককে অন্ধ-বিকলাঙ্গ ও ভিক্ষুকরূপে দেখার কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা আবরাহা বাহিনীকে যে পাখির মাধ্যমে ধ্বংস করেছেন, কুরআনে কারীম সে ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে,
وَاَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا اَبَابِيْلَ
তিনি তাদের উপর প্রেরণ করেছেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। (সূরা ফীল, আয়াত:৪)
এখানে উল্লিখিত اَبَابِيْلَ শব্দটি বহুবচন। কিন্তু আরবী ভাষায় এর কোন এক বচনের ব্যবহার পাওয়া যায় না। এর অর্থ পাখির ঝাঁক। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে ‘আবাবীল’ কোন পাখির নাম নয়, বরং এ শব্দ দ্বারা সেই পাখির আধিক্য বুঝানো হয়েছে। এই পাখির আকারে কবুতর অপেক্ষা একটু ছোট ছিল। কিন্তু এ জাতীয় পাখি এর পূর্বে কখনোই দেখা যায়নি। (আহকামুল কুরআন)
হস্তিবাহিনীর উপর যে কংকর নিক্ষিপ্ত হয়েছিল কুরআনে কারীমে সে ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, بِحِجَارَةٍ مِّنْ سِجِّيْلٍ (পাথরজাতীয় কংকর দ্বারা।) ভেজা মাটি আগুনে পুড়িয়ে যে কংকর তৈরি করা হয়, সে কংকরকে سِجِّيْلٍ বলা হয়। এতে ইঙ্গিত রয়েছে, এই কংকর কেবল সাধারণ মাটি ও আগুনের তৈরি ছিল, যার নিজস্ব কোন বিশেষ শক্তি ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার কুদরতে ঐ কংকর রাইফেলের গুলির চেয়ে বেশি কাজ করেছিল। যার ফলে আবরাহা বাহিনী ধ্বংস হয়ে ভক্ষিত ভূষির ন্যায় হয়ে গিয়েছিল।
নিম্নোক্ত আয়াতে এ কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে,
فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّاْكُوْلٍ
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের ভক্ষিত ভূষিসদৃশ করে দেন। (সূরা ফীল, আয়াত:৫)
উল্লিখিত আয়াতে বর্ণিত عَصْف শব্দের অর্থ ভূষি। ভূষি নিজেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন তৃণ। তদুপরি যদি কোন জন্তু সেটিকে চাবায়, তবে এই তৃণও আর তৃণ থাকে না, বরং সম্পূর্ণ নিষ্পেষিত গুঁড়া হয়ে যায়। কংকর নিক্ষিপ্ত হওয়ার ফলে আবরাহার সৈন্যবাহিনীর অবস্থাও তদ্রুপই হয়েছিল।