হযরত যাকারিয়া আ. ও হযরত ইয়াহইয়া আ. এর জীবনে আল্লাহ তা‘আলার অপূর্ব নিদর্শন
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
اِذْ قَالَتِ امْرَاَةُ عِمْرَانَ رَبِّ اِنِّىْ نَذَرْتُ لَكَ مَا فِىْ بَطْنِىْ مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّىْ اِنَّكَ اَنْتَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ○ فَلَمَّا وَضَعَتْهَا قَالَتْ رَبِّ اِنِّىْ وَضَعْتُهَاۤ اُنْثٰى وَاللّٰهُ اَعْلَمُ بِمَا وَضَعَتْ وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالْاُنْثٰى وَاِنِّىْ سَمَّيْتُهَا مَرْيَمَ وَاِنِّىْ اُعِيْذُهَا بِكَ وَذُرِّيَّتَهَا مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ○ فَتَقَبَّلَهَا رَبُّهَا بِقَبُوْلٍ حَسَنٍ وَاَنۢبَتَهَا نَبَاتًا حَسَنًا وَّكَفَّلَهَا زَكَرِيَّا كُلَّمَا دَخَلَ عَلَيْهَا زَكَرِيَّا الْمِحْرَابَ وَجَدَ عِنْدَهَا رِزْقًا قَالَ يٰمَرْيَمُ اَنّٰى لَكِ هٰذَا قَالَتْ هُوَ مِنْ عِنْدِاللّٰهِ انَّ اللّٰهَ يَرْزُقُ مَنْ يَّشَآءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ ○هُنَالِكَ دَعَا زَكَرِيَّا رَبَّهٗ قَالَ رَبِّ هَبْ لِىْ مِنْ لَّدُنْكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً اِنَّكَ سَمِيْعُ الدُّعَآءِ ○
অর্থ: স্মরণ করুন, যখন ইমরানের স্ত্রী বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক, আমার গর্ভস্থ সন্তানকে একান্ত আপনার জন্য উৎসর্গ করলাম। সুতরাং আপনি আমার প্রার্থনা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী। অতঃপর যখন সে সন্তান প্রসব করল, তখন বললো, হে আমার প্রতিপালক, আমি কন্যাসন্তান প্রসব করেছি; সে যা প্রসব করেছে, সে সম্বন্ধে আল্লাহ সম্যক অবগত। আর (ঐ কাঙ্ক্ষিত) ছেলে সন্তান (এই) মেয়ে সন্তানের মতো নয়। আমি তার নাম মারিয়াম রেখেছি। আমি তাকে ও তার বংশধরদের অভিশপ্ত শয়তান থেকে আপনার আশ্রয়ে সোপর্দ করছি। অতঃপর তার প্রতিপালক তাকে উত্তমরূপে কবুল করে নিলেন এবং তাকে উত্তমরূপে প্রতিপালন করলেন। আর তাকে যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালামের তত্ত্বাবধানে দিলেন। যখনই যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালাম মারিয়াম আ. এর কক্ষে যেতেন, তখনই তার নিকট বিশেষ খাদ্যসামগ্রী দেখতে পেতেন। তিনি বললেন, হে মারিয়াম, তোমার জন্য এসব কোত্থেকে এলো? মারিয়াম উত্তর দিলেন, এসব আল্লাহর পক্ষ হতে এসেছে। নিশ্চয় আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দান করেন। সেখানেই যাকারিয়া তার প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করে বললেন, হে আমার প্রতিপালক, আমাকে আপনি নিজের পক্ষ হতে সৎ বংশধর দান করুন। নিশ্চয় আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী। (সূরা আল-ইমরান; আয়াত: ৩৫-৩৮)
যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালামের জন্ম ও বংশপরিচয়
হযরত যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালামের পিতার নাম ‘বরখিয়া।’ কোন কোন মুফাসসির বলেন, ‘উদন’। তার স্ত্রী তথা ইয়াহইয়া ‘আলাইহিস সালামের মায়ের নাম ছিল ‘ঈশা’।
হযরত যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালাম খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ৯১ অব্দে বর্তমান প্যালেস্টাইনে জন্মগ্রহণ করেন এবং দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দে নবুওয়্যাত প্রাপ্ত হন। পবিত্র কুরআনে চারটি সূরায় তার নাম মোট সাতবার উল্লেখ হয়েছে। তার একমাত্র সন্তান হযরত ইয়াহইয়া ‘আলাইহিস সালাম। তিনিও একজন নবী। উল্লিখিত আয়াতে বর্ণিত হযরত যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালামের দু‘আর পরিপ্রেক্ষিতেই আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে এই পুত্রসন্তান দান করেছিলেন।
সকল নবীরই বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তাঁরা আপন জীবিকার ব্যবস্থা নিজ হাতেই করতেন। এ ব্যাপারে তাঁরা কারো দ্বারস্থ হতেন না। বরং একথা বলতেন,
ما اسئلكم عليه من اجر ان اجري الا علي رب العلمين
অর্থ: আমি এ কাজের বিনিময়ে তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না। আমার প্রতিদান বিশ্বজগতের প্রতিপালক নিজ দায়িত্বে রেখেছেন। (সূরা শু‘আরা- ১০৯)
এই ‘নববী বৈশিষ্ট্যে’ হযরত যাকারিয়া আ.-ও ব্যতিক্রম ছিলেন না। সহীহ মুসলিমের এক বর্ণনায় এসেছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
كان زكرياءنجارا
অর্থাৎ ‘যাকারিয়া আ. কাঠের কাজ করতেন’। (সহীহ মুলিম, ফাযাইল অধ্যায়, হাদীস নং: ১৬৯। আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড: ২, পৃষ্টা: ৪৯)। এর মাধ্যমেই নিজের জীবিকা নির্বাহ করতেন।
মারিয়াম আলাইহাস সালামের লালন-পালনে যাকারিয়া আ.-এর ভূমিকা
পবিত্র কুরআনের উল্লিখিত আয়াতে ইমরান-কন্যা হযরত মারিয়াম ‘আলাইহাস সালামের জন্ম ও বাল্যকালের ঘটনাকে কেন্দ্র করে হযরত যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালামের আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। সে আলোচনায় আবার তাঁর সন্তান হযরত ইয়াহইয়া ‘আলাইহিস সালামের আলোচনা এসেছে।
আল্লামা ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, ইমরান-কন্যা মারিয়ামকে যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালামের তত্ত্বাবধানে প্রদানের কারণ হল, তিনি পিতৃহীন ছিলেন। মুসতাদরাকে হাকিমে বর্ণিত এক হাদীসের ভাষ্যমতে, পিতা তো আগেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন, অতঃপর মারিয়াম ‘আলাইহাস সালামের মাতার মৃত্যুর পর তাকে যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালামের তত্ত্বাবধানে দেয়া হয়। (মুসতাদরাকে হাকীম, ৩:২০৭)
এ থেকে বুঝা যায়, শিশু মারিয়াম ‘আলাইহাস সালামকে যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালামের তত্ত্বাবধানে দেয়ার সময় তার বাবা-মা কেউ জীবিত ছিলেন না। কোন কোন মুফাসসির বলেন, সে বছর বনী ইসরাইল সম্প্রদায়ের মাঝে দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। এ কারণে যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালাম শিশু মারিয়ামকে নিজের তত্ত্বাবধানে নিয়েছিলেন।
তবে মারিয়াম ‘আলাইহাস সালামকে নিজের দায়িত্বে নিতে যাকারিয়া অলাইহিস সালামকে প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
ذٰلِكَ مِنْ اَنَبَآءِ الْغَيْبِ نُوْحِيْهِ اِلَيكَ وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ اِذْ يُلْقُوْنَ اَقْلَامَهُمْ اَيُّهُمْ يَكْفُلُ مَرْيَمَ وَمَا كُنْتَ لَدَيْهِمْ اِذْ يَخْتَصِمُوْنَ ○
‘এটা গাইবের সংবাদ, যা আমি আপনার নিকট ওহী পাঠাচ্ছি। আপনি তাদের নিকট ছিলেন না, যখন তারা কলম নিক্ষেপ করছিল (এ ফায়সালা করার জন্য) যে, মারিয়ামের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাদের মধ্যে কে গ্রহণ করবে এবং আপনি তাদের নিকট ছিলেন না, যখন তারা বাদানুবাদ করছিল’। (সূরা আল- ইমরান, আয়াত:৪৪)
এর বিস্তারিত ঘটনা হল, ইকরীমা রা. বলেন, মারিয়াম ‘আলাইহাস সালামের আম্মা মারিয়াম ‘আলাইহাস সালামকে কোলে নিয়ে কাহিন বিন হারুন ‘আলাইহিস সালামের বংশধরের কাছে গেলেন। তখন তারা বায়তুল মুকাদ্দাসের দায়িত্বে ছিলেন। ইমরান ‘আলাইহিস সালামের স্ত্রী হান্না তাদের বললেন, মান্নতকৃত এই শিশুটি আপনারা রাখুন। কারণ, আমি তাকে বায়তুল মুকাদ্দাসের খেদমতের জন্য উৎসর্গ করেছি। আর এই হল আমার মেয়ে। জানি, ঋতুমতী নারীরা গির্জায় প্রবেশ করে না, তবু আমি একে বাড়িতে ফিরিয়ে নিব না। তারা বললেন, এ তো আমাদের ইমাম সাহেবের মেয়ে, যিনি আমাদের জন্য উৎসর্গিত ছিলেন। (মারিয়াম ‘আলাইহাস সালামের বাবা ইমরান ‘আলাইহিস সালাম তাদের নামাযের ইমামতি করতেন।) সেসময় যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালাম বললেন, একে আমার তত্ত্বাবধানে দাও। কারণ, আমার স্ত্রী এর খালা। তখন তারা বললেন, না, এতে আমরা সন্তুষ্ট নই। সে হল আমাদের ইমাম সাহেবের মেয়ে। আমরা তার তত্ত্বাবধান করবো। শেষে সিদ্ধান্ত হয়, এ ব্যাপারে ভাগ্যপরীক্ষা করা হবে। এতে যার নাম আসবে, তিনিই হবেন মারিয়াম ‘আলাইহাস সালামের তত্ত্বাবধায়ক। সেমতে তারা সকলে জর্ডান নদীর তীরে গিয়ে ভাগ্যপরীক্ষা শুরু করলেন। ভাগ্যপরীক্ষার পদ্ধতি সাব্যস্ত হল, এতে যারা অংশগ্রহণ করবেন, তারা সকলে নিজ নিজ কলম নদীতে নিক্ষেপ করবেন। প্রবহমান পানিতে যার কলম ভেসে থাকবে, তিনিই হবেন মারিয়ামের তত্ত্বাবধায়ক। কথামতো সকলেই নিজ নিজ কলম নদীতে নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালামের কলম ব্যতীত সবার কলম পানিতে ডুবে গেল। ফলে যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালাম মারিয়াম ‘আলাইহাস সালামের তত্ত্বাবধায়ক সাব্যস্ত হলেন। (তাফসীরে ইবনে কাসির, ২:৪৭)
বস্তুত ইমরান-কন্যার সৌভাগ্যই বলতে হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালামকে তার তত্ত্বাবধানে নিয়োগ করেন। এতে মারিয়াম ‘আলাইহাস সালামের জন্য তাঁর থেকে কল্যাণ ও জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ তৈরি হয় এবং সুন্দর চরিত্র-মাধুর্য ও আমল-আখলাক শিক্ষার ব্যবস্থা হয়। তাছাড়া যাকারিয়া ‘আলাইহিস সালাম ছিলেন মারিয়াম ‘আলাইহাস সালামের খালুজান। স্বভাবতই তিনি তার প্রতি স্নেহভাজন ছিলেন।