গাযওয়ায়ে আহযাব
আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,
اَلَمْ تَرَ اِلَی الَّذِیْنَ اَوْتُوْا نَصِیْبًا مِّنَ الْکِتٰبِ یُؤْمِنُوْنَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوْتِ وَیَقُوْلُوْنَ لِلَّذِیْنَ کَفَرُوْا هٰۤؤُلَآءِ اَهْدٰی مِنَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا سَبِیْلًا ○اَولٰٓئِکَ الَّذِیْنَ لَعَنَهُمُ اللهُ ؕ وَمَنْ یَّلْعَنِ اللهُ فَلَنْ تَجِدَ لَهٗ نَصِیْرًا○
আপনি কি তাদের দেখেননি, যারা কিতাবের কিছু অংশ প্রাপ্ত হয়েছে যে, তারা প্রতিমা ও শয়তানকে মান্য করছে এবং কাফেরদের বলছে, এরা মুমিনদের তুলনায় অধিকতর সরল সঠিক পথে রয়েছে? এরাই সেই লোক, যাদের আল্লাহ তা‘আলা লানত করেছেন। আর আল্লাহ তা‘আলা যাকে লানত করেন, আপনি কখনও তাদের কোন সাহায্যকারী পাবেন না। (সূরা নিসা, আয়াত:৫১-৫২)
এ আয়াতে গাযওয়ায়ে আহযাব বা খন্দকের জিহাদ-সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে। মদীনা থেকে বিতাড়িত ইহুদী বনু নাযির সম্প্রদায় মক্কার কাফেরদের সাথে হাত মিলিয়ে তাদের প্রতি মিথ্যা তোষামোদ দেখিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কাফেরদের উত্তেজিত করেছিল সেসম্পর্কে এখানে আলোকপাত করা হয়েছে।
সূরা আহযাবে গাযওয়ায়ে আহযাব বা খন্দকের যুদ্ধের বিভিন্ন অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। হাদীস শরীফে উক্ত জিহাদের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। কুরআন ও হাদীসের আলোকে নিম্মোক্তগাযওয়ায়ে আহযাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হচ্ছে।
গাযওয়ায়ে আহযাব-এর বিবরণ
কুরাইশরা উহুদ থেকে ফিরে যাওয়ার আগে মুসলিমদের বিরুদ্ধে দম্ভভরে জানিয়ে গিয়েছিল, আগামী বছর বদরপ্রান্তরে তোমাদের সাথে আবার মোকাবেলা হবে। কিন্তু নিজেদের দুর্বলতা উপলব্ধি করে পরবর্তী বছর বদরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেও রাস্তা থেকেই তারা ফিরে গিয়েছিল।
তৎকালীন মক্কার কাফেরদের সরদার আবু সুফিয়ান বুঝতে পেরেছিল, উহুদের মত স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে মুসলিমদের পরাজিত করা সম্ভব নয়। তাদের পরাজিত করতে হলে ব্যাপক ও শক্তিশালী বাহিনীর প্রয়োজন। তাই তারা সারা আরববাসীকে কীভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করতে লাগলো।
অন্যদিকে বনু নাযীরের ইহুদীরা মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়ে খায়বারে এসে বসতি স্থাপন করেছিল। সেখানে তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র স্থাপন করে। এ সময় তারা সিদ্ধান্ত নিলো, মক্কায় গিয়ে কুরাইশদের মুহাম্মাদ-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পরে একযোগে হামলা চালিয়ে মুসলিমদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।
সেই মোতাবেক হুয়াই ইবনে আখতাব, সাল্লাম ইবনে আবুল হুকাইক, কিনানা ইবনে রবী প্রমুখ ইহুদী সরদার মক্কায় গিয়ে কুরাইশদের মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে উদ্বুদ্ধ করতে লাগলো। তারা বললো, ভয় করবেন না। আমরা আপনাদের সাথেই আছি। আমরা মুহাম্মাদকে ধ্বংস করেই তবে দম নিব। সেজন্য আমরা আপনাদের সাথে চুক্তি করতে এসেছি। তখন তারা এ কথাও বললো, আপনারাই বাস্তবে সত্যের উপর আছেন।
এ কথা শুনে কুরাইশরা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। তাদের মধ্যে নতুন করে শক্তি ও সাহস সঞ্চার হলো। ক্রমশ তাদের মধ্যকার চাপা ক্রোধ ও ক্ষোভের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো।
ফলে তারা ইহুদীদের খুব খাতির-তোয়াজ করলো। তারপর আনন্দে-আহলাদে আটখানা হয়ে তাদের বললো, হ্যাঁ, আমরা তো এটাই চাই। মুহাম্মাদের শত্রুরাই আমাদের বন্ধু। এবার তা হলে আমরা সবাই একসাথে মিলে তার দর্প চূর্ণ করে দিতে পারবো।
এরপর কুরাইশরা বললো, ভাইসব, আগে থেকেই তো আপনাদের কাছে আসমানি কিতাব আছে। মুহাম্মাদের সাথে আমাদের দ্বন্দ্ব রয়েছে, তা আপনারা জানেন। কিন্তু আপনারা যে বললেন, আমরাই সত্যের উপর আছি, অনুগ্রহ করে খুলে বলবেন কি যে, আমাদের ধর্ম ঠিক নাকি মুহাম্মাদের ধর্ম ঠিক?
তখন হতভাগ্য মিথ্যুক ইহুদীরা বললো, তাওবা তাওবা! তোমাদের ধর্মের সাথে কি তার ধর্মের কোন তুলনা হতে পারে? তোমরাই প্রকৃত সত্যের উপর আছ। তোমাদের ধর্মই মুহাম্মাদের ধর্ম থেকে উৎকৃষ্ট।
এদের এ মন্তব্য সম্পর্কেই আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের উক্ত আয়াতে বলেছেন। আর তাদের এ মিথ্যা কথার কারণে তাদের উপর লানত করেছেন।
এভাবে ইহুদীরা কুরাইশদের সাথে উত্তেজনাকর কথাবার্তা বলতে লাগলো। কুরাইশদের সাথে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা কথা বলে তাদের উত্তেজিত করে তুললো। পরিশেষে কুরাইশরা ইহুদীদের ধোঁকাবাজিতে পড়ে ক্রোধে অন্ধ হয়ে বলতে লাগলো, আমাদের শরীরের শেষ রক্তবিন্দুটুকু দিয়ে হলেও আমরা মুহাম্মাদের সাথে লড়বো। মুহাম্মাদের ধর্ম আমরা কিছুতেই ছড়িয়ে পড়তে দিব না। মুহাম্মাদের কবল থেকে দুনিয়াকে আমরা রক্ষা করবোই। তার ধর্মের নাম-নিশানা মিটিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না।
কুরাইশদের সমর্থন পেয়ে এবার বনী নাযীরের ইহুদীরা গাতফানীদের নিকট গমন করলো। তাদের লোভ দেখালো যে, তোমরা যদি আমাদের সাথে যোগ দাও, তা হলে খায়বারে উৎপাদিত শস্যের অর্ধেক তোমাদেরদের দিব।
গাতফানীরা পূর্ব থেকেই মুসলিমদের চরম শত্রু ছিল। বীরে মাউনার ঘটনায় যে সত্তরজন কারী-আলেম সাহাবী শহীদ হয়েছিলেন, এর পিছনে তাদেরই ষড়যন্ত্র ছিল। তাই ইহুদীদের প্রস্তাব পেয়ে তারা সাথেসাথে রাজি হয়ে গেল।
ওদিকে বনু আসাদ গোত্র গাতফান গোত্রের সাথে চুক্তিবদ্ধ ছিল। সে কারণে তারাও গাতফানদের আহ্বানে বেরিয়ে পড়লো। আবার বনু সুলাইম গোত্রের সাথে কুরাইশদের আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকায় তারাও কুরাইশদের সঙ্গী হলো। তেমনিভাবে বনু সাদ গোত্র ইহুদীদের সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকায় তারাও আর বসে থাকতে পারলো না। সম্মিলিত মুসলিমবিরোধী বাহিনীতে যোগ দিল।
মোটকথা, এবার সমগ্র আরব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে একজোট হলো। সবাই নিজেদের শয়তানি পরিকল্পনা ও অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে ইসলামের দীপ্তিময় আলো চিরতরে নিভিয়ে দেওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ হলো।
সর্বপ্রথম আবু সুফিয়ান তিনশ ঘোড়া, একহাজার উট, চার হাজার কুরাইশ সৈন্য নিয়ে মক্কা ত্যাগ করলো। তারা যখন ‘মাররুয যাহরান’নামক স্থানে পৌঁছালো, তখন গাতফান, আসাদ, ফাযারা, আশজা, মুররা প্রভৃতি গোত্রের সৈন্যরা এসে তাদের সাথে যোগ দিল। এতে মোট সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ালো দশ হাজার।
সমস্ত সৈন্য তিন ভাগে বিভক্ত করা হলো। আবু সুফিয়ান কুরাইশদের, উয়াইনা ইবনে হিস্ন গাতফানীদের এবং তুলায়হা আসাদ গোত্রের সেনাপতি মনোনীত হলো। আবু সুফিয়ান হলো কমান্ডার ইন চিফ। আর অন্য সৈন্যরা এই তিন বাহিনীর মধ্যে ভাগ হয়ে গেল।
মুসলমানদের ধরাপৃষ্ঠ থেকে নিশ্চিহ্ন করতে দশ হাজারের অধিক রক্তপিপাসু দুর্ধর্ষ এই ইহুদী ও কুরাইশ-পৌত্তলিকের যৌথবাহিনী মদীনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো।
রাসূলুল্লাহর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা: পরিখা খনন
ইসলামের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর এ অভিযানের সংবাদ যথাসময়ে মদীনায় পৌঁছে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসম্পর্কে পরামর্শ করার জন্য বিশিষ্ট সাহাবীদের এক পরামর্শসভা আহ্বান করলেন।
উক্ত সভায় এ পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলো। এবার শত্রুদের প্রতিরোধ করার জন্য মদীনার বাইরে যাওয়া সমীচীন হবে, নাকি ভিতরে থেকেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে- এসম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করা হলো। পরিশেষে সিদ্ধান্ত হলো, মদীনায় থেকেই তাদের মোকাবেলা করা হবে।
তখন হযরত সালমান ফারসী রা. (যিনি পূর্বে পারস্যবাসী ছিলেন) পারস্যের লোকদের এক অভিনব প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থার বিবরণ প্রস্তাবরূপে পেশ করলেন। তিনি বললেন, মদীনার যে দিকটি অরক্ষিত, সেদিকে গভীর খন্দক বা পরিখা খনন করলে ভালো হয়। যাতে শত্রুসৈন্যরা তা পার হয়ে শহরে ঢুকতে না পারে।
তার এই নতুন পরিকল্পনা সকলে পছন্দ করলেন। আরববাসীরা যুদ্ধের এই অভিনব ব্যবস্থাপনা আগে কোনদিন শোনেনি। তাই তারা খুব বিস্মিত হলেন এবং তা সাদরে গ্রহণ করলেন।
মদীনার তিন পাশে ছিল ঘরবাড়ি ও খেজুর বাগান। তাতে সাধারণভাবে শহর রক্ষার কাজ হতো। একমাত্র সিরিয়ার দিকটি খোলা ছিল। সেদিকে ছিল সালা পাহাড়। সুতরাং সালা পাহাড়কে ভেতরে রেখে তার বাইরের দিকে পরিখা খননের সিদ্ধান্ত হলো।
পঞ্চম হিজরির যিলকদ মাসের ৮ তারিখে এই খনন কাজ শুরু হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাজের শৃঙ্খলার জন্য সাহাবীদেরকে দশজনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করে দিলেন। সেই সাথে খননের জন্য প্রত্যেক দলকে দশ গজ করে চিহ্নিত করে দিলেন। পরিখার দৈর্ঘ্য পূর্ব হাররা হতে পশ্চিম হাররা পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার গজ। লাফ দিয়ে ঘোড়া পার না হতে পারে সেই পরিমাণ প্রস্থ রাখা হয়েছিল। আর গভীরতা করা হয়েছিল পাঁচ গজ ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আদর্শ আমীর। যেকোন কাজে সবার সাথে শরীক হয়ে সহকর্মী হওয়া ছিল তাঁর মহান গুণ। তাই মসজিদে নববীর ন্যায় এখানেও তিনি ঝুড়ি-কোদাল হাতে নিয়ে খনন কাজে যোগ দিলেন।
মাটিতে সর্বপ্রথম তিনি যখন কোদাল ফেললেন, তখন মুখে উচ্চারণ করলেন,
بسم الله ربنا بدينا ولو عبدنا غيره شقينا حبذا ربا وحبذا دينا
‘আল্লাহর নামে এ খননটি শুরু করছি। যদি আমরা তার ব্যতীত আর কারো ইবাদত করতাম, তা হলে বড় দুর্ভাগা হতে হতো। কত উত্তম রব তিনি, কত উত্তম তার দেওয়া এ দীন। (আল রউযুল উনুফ, ৩:১৮৯; ফাতহুল বারী, ৭:৩০৪)
তখন ছিল শীতকাল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস বইছিল। আনসার ও মুহাজির সাহাবীগণ একান্ত আগ্রহ ও মনোযোগের সাথে খন্দক খুঁড়ে চলছিলেন। তারা গর্ত থেকে মাটি উঠাতে থাকেন এবং সাথে সাথে বলতে থাকেন,
نحن الذين بايعوا محمدا+ على الجهاد ما بقينا ابدا
‘আমরা হলাম সেই সেনাদল, যারা কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে হাত রেখে জিহাদের বাই‘আত-অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছি। যতদিন আমাদের দেহে প্রাণ থাকবে, ততদিন আমরা এ বায়আতে অটুট থাকব।’
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের এ কথার জবাবে বললেন,
اَللّٰهُمَّ ان العيش عيش الاخرة + فاغفر للانصار والمهاجرة
‘আয় আল্লাহ, সত্যিকারের জীবন তো আখিরাতের জীবন। আপনি মেহেরবানী করে আনসার ও মুহাজিরদের সকল গুনাহ মাফ করে দিন।’
হযরত বারা ইবনে আযেব রা. বলেন, খন্দক খননের দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাটি তুলে দূরে ফেলতে থাকেন। এমনকি এতে তার পবিত্র দেহ মোবারক ধুলোয় ধূসরিত হয়ে যায়। তিনি তখন বলছিলেন,
والله لو لا انت ما اهتدينا + ولا تصدقنا ولا صلينا
فانزلن سكينة علينا + وثبت الاقدام ان لاقينا
ان الالى قد بغوا علينا + اذا ارادوا فتنة ابينا
‘আল্লাহর কসম, হে আল্লাহ, যদি আপনি না থাকতেন, তা হলে আমরা হেদায়েত পেতাম না। আর না আমরা সদকা করতাম এবং না নামায পড়তাম। (আয় আল্লাহ,) আমাদের উপর রহমতের সাকিনা নাযিল করুন এবং শত্রুর সাথে মোকাবেলা হলে তাতে আমাদের পাগুলো দৃঢ়-অবিচল রাখুন। পৌত্তলিকরা আমাদের উপর জুলুমের খড়গ হেনেছে। তারা আবার যদি আমাদের মধ্যে কোন ফেতনা সৃষ্টি করতে চায়, আমরা তা হতে দিব না।’
এই শেষ শব্দ “ابينا, ابين ” (অর্থাৎ ‘আমরা হতে দিব না’, ‘আমরা হতে দিব না’কথাটি) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উচ্চস্বরে বারবার বলছিলেন আর তখন সাহাবায়েকেরামও তার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলছিলেন, “ابينا, ابين ”আমরা তা হতে দিব না, আমরা তা হতে দিব না।
পরিখা খননের সময় মুজিযার প্রকাশ
প্রখ্যাত সীরাত ও মাগাযী বিশেষজ্ঞ আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, পরিখা খননকালে ঘটে যাওয়া বহু ঘটনা আমি শুনেছি। যা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তার রাসূলের সমর্থন ও তার নবুওয়্যাতের প্রত্যয়নকল্পে সংঘটিত হয়েছিল। সেসব ঘটনা সাহাবীগণ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তার মধ্য হতে কয়েকটি ঘটনা নিম্মরূপ।
হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন, একটা বৃহদাকার শক্ত পাথর সাহাবীগণের পরিখা খননে সমস্যা সৃষ্টি করছিল। তারা বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবহিত করেন।
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি পাত্রে পানি আনতে বললেন। পানি আনা হলে তিনি তাতে থুথু ফেলে আল্লাহর দরবারে খুব দু‘আ করলেন। তারপর উক্ত পাথরে সেই পানি ঢেলে দিলেন। সেখানে উপস্থিত লোকেরা বলেন, ‘আল্লাহর কসম, যিনি তাকে সত্য নবী করে পাঠিয়েছেন, পানি ঢালামাত্র পাথরটি নরম বালুর স্তূপে পরিণত হলো।
ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, সায়িদ ইবনে মিনা রহ. আমার কাছে বর্ণনা করেন, বাশির ইবনে সা‘দ-এর কন্যা (প্রখ্যাত সাহাবী নোমান ইবনে বাশির রা. এর বোন) বলেন (তখন তিনি ছোট ছিলেন), ‘আমার মা বিনতে রাওয়াহা আমাকে ডেকে আমার কাপড়ে এক মুষ্টি খেজুর ঢেলে দিলেন। তারপর বললেন, আমার প্রিয় কন্যা, তুমি এগুলো তোমার পিতা ও তোমার মামা আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার কাছে নিয়ে যাও। তারা এ দিয়ে দুপুরের আহার করবেন। আমি সেগুলো নিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমি তাদের খোঁজাখুঁজি করছি, এমন সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আমার দেখা হলো। তিনি বললেন, ‘খুকি, এদিকে এসো! তোমার কাছে এগুলো কী?’আমি বললাম, আল্লাহর রাসূল, এগুলো খেজুর। আমার মা এগুলো আমার পিতা বাশির ইবনে সা‘দ ও মামা আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার কাছে পৌঁছানোর জন্য পাঠিয়েছেন। তারা তা দিয়ে দুপুরের আহার করবেন।’ এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ওগুলো আমার কাছে দাও। তখন আমি তা তার হাতে তুলে দিলাম। কিন্তু পরিমাণে তা এতই কম ছিল যে, তার হাত ভরলো না।
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি কাপড় বিছাতে বললেন। কাপড় বিছানো হলো। তিনি খেজুরগুলো সেই কাপড়ের উপর ছড়িয়ে দিলেন। তারপর পাশে উপস্থিত একজনকে বললেন, পরিখা খননকারী সকলকে ডাকো, তারা দুপুরের আহার সেরে যাক।
কিছুক্ষণের মধ্যে সকলে উপস্থিত হলেন এবং সেখান থেকে খেজুর খাওয়া শুরু করলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তারা যতই খেজুর খাচ্ছিলেন, খেজুর ততই বাড়ছিল। অবশেষে পরিখা খননকারী সকলে যখন পেট পুরে খেয়ে উঠলেন, তখনও কাপড়ের চারপাশে খেজুর উপচে পড়ছিল। সুবহানাল্লাহ !!!
ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, আমার কাছে সায়িদ ইবনে মিনা জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. এর সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে খননে শরীক ছিলাম। আমার একটি ছোট ছাগল ছিল। তেমন মোটা-তাজা নয়। মনে মনে বললাম, এ ছাগল দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য আহারের ব্যবস্থা করলে ভালো হবে। আমি আমার স্ত্রীকে তা জানিয়ে তাকে খাবার আয়োজন করতে বললাম।
সে কিছু যব পিষে রুটি তৈরি করলো এবং আমি ছাগলটি জবাই করলাম। আমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্য ছাগলটি ভুনা করলাম।
খনন কাজে আমাদের নিয়ম ছিলো, দিনভর কাজ করতাম এবং সন্ধ্যা হলে বাড়িতে ফিরে আসতাম। সেদিন সন্ধ্যাবেলা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিখাস্থল হতে প্রস্থান করতে যাচ্ছিলেন, তখন আমি বললাম, আল্লাহর রাসূল, আমার একটি ছোট ছাগল ছিল, সেটি আপনার জন্য ভুনা করেছি, আর কিছু যবের রুটি তৈরি করেছি। আশা করি, আপনি আমার বাড়িতে যাবেন।
জাবের রা. বলেন, আমার ইচ্ছা ছিল নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাই আসবেন। কিন্তু আমি একথা বলামাত্র তিনি বললেন, অবশ্যই। তারপর একজনকে নির্দেশ দিলেন, সকলকে ডাক দিয়ে বলো, তোমরা আল্লাহর রাসূলের সাথে জাবের ইবনে আবদুল্লাহর বাড়িতে দাওয়াত খেতে চলো। আমি পেরেশান হয়ে গেলাম।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকলকে নিয়ে আমার বাড়ি এলেন। তারা এসে বসার পর আমরা উক্ত খাদ্য দ্রব্য তার সামনে বের করলাম। তিনি বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করলেন। স্থান সংকুলান হচ্ছিল না বিধায় পালাক্রমে একদল করে এসে খেয়ে যাচ্ছিলেন। এভাবে পরিখা খননকারী সকল সাহাবীই সেই খাবার তৃপ্তিসহকারে খেলেন। তারপরও তার কিছু অংশ রয়ে গিয়েছিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এ খাবার তোমাদের (ঘরওয়ালাদের) জন্য।’
ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, আমি শুনেছি, সালমান রা. বলেন, আমি পরিখার একপ্রান্তে খননকার্যে লিপ্ত ছিলাম। সহসা একটি কঠিন পাথর আমার সামনে পড়লো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাছেই ছিলেন। তিনি দেখলেন, আমি বারবার কোদাল মারছি, কিন্তু পাথরটার কোন কিনারা করতে পারছি না।
তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে আমার হাত থেকে কোদাল নিয়ে পাথরটার উপর সজোরে তিনবার আঘাত করলেন। দেখলাম প্রতিবারই পাথর থেকে আলোর ঝলক বের হলো। আমি বললাম, আল্লাহর রাসূল, আপনার উপর আমার পিতামাতা কুরবান হোক, আপনি আঘাত করার সময় প্রতিবারই যে আলোর ঝিলিকের বিচ্ছুরণ হয়, এর কারণ কী? তিনি বললেন, তুমি কি এটা দেখেছ, হে সালমান? আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি দেখেছি। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, প্রথম ঝলকে আল্লাহ তা‘আলা আমার জন্য ইয়ামানের চাবি আমাকে প্রদান করেন এবং তার বিজয়ের ইঙ্গিত দেন। দ্বিতীয় ঝলকে শাম ও পশ্চিম দেশের চাবি আমাকে প্রদান করেন এবং তৃতীয় ঝলক দ্বারা পূর্বদেশের চাবি আমাকে দেন এবং এসব দেশ বিজয়ের ইঙ্গিত দেন।
ইবনে ইসহাক রহ. বলেন, হযরত আবু হুরায়রা রা. এর সূত্রে এমন একব্যক্তি আমার নিকট বর্ণনা করেছেন, যার বিশ্বস্ততায় আমার কোন সন্দেহ নেই, তিনি বলেন, হযরত উমর রা. ও হযরত উসমান রা. এবং তাদের পরবর্তী খলীফার যুগে যখন এসব দেশ বিজিত হয়, তখন আবু হুরায়রা বলতেন, তোমরা যা ইচ্ছা জয় করতে থাকো। আল্লাহর কসম, যার হাতে আবু হুরায়রার প্রাণ, তোমরা যেসব দেশ জয় করেছ এবং কিয়ামত পর্যন্ত আরও জয় করবে, তার চাবি আল্লাহ তা‘আলা পূর্বেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে অর্পণ করেছেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম)
পরিখা তৈরি হয়ে গেল
আল্লাহ তা‘আলার খাস রহমতে সাহাবীগণের বিরামহীন মেহনতের ফলে মাত্র ছয় দিন মতান্তরে বিশ দিনে প্রায় তিন হাজার গজ লম্বা ও পাঁচ গজ গভীর পরিখা খননের কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণকে কাফের বাহিনীর মোকাবেলার জন্য বিন্যস্ত করেন।
জিহাদে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
وَ اَعِدُّوْا لَهُمْ مَّا اسْتَطَعْتُمْ مِّنْ قُوَّۃٍ وَّمِنْ رِّبَاطِ الْخَیْلِ تُرْهِبُوْنَ بِهٖ عَدُوَّ اللهِ وَعَدُوَّكُمْ وَ اٰخَرِیْنَ مِنْ دُوْنِهِمْ
তোমরা কাফেরদের মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণ করো, যারা সক্ষমতা রাখো শক্তি-সামর্থের মধ্য থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে। এগুলোর দ্বারা তোমরা ভীত-সন্ত্রস্ত কর আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদের এবং তাদের ছাড়াও অন্যদের। (সূরা আনফাল, আয়াত:৬০)
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের কাফেরদের মোকাবেলা করার জন্য নিজেদের সবরকম শক্তি-সামর্থ্যের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আলোচ্য গাযওয়ায়ে আহযাবে পরিখা খনন এ সামর্থের ব্যবস্থারই অংশ ছিল।
বস্তুত আরবদের মাঝে পরিখা খনন করার কোন প্রচলন ছিল না। এটি ছিল পারস্য এলাকায় প্রচলিত পদ্ধতি। পারস্যরাজ মনুশাহর ইবনে উবাইরিজ ইবনে আফরিদুন সর্বপ্রথম এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সালমান ফারসী রা. এর পরামর্শ অনুযায়ী পরিখা খননের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
এতে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয় যে, প্রয়োজন হলে, অমুসলিমদের বৈধ যুদ্ধরীতি অনুসরণ করে যুদ্ধ করা ইসলামী আইনে অনুমোদিত। তেমনি কাফেরদের উদ্ভাবিত যাবতীয় অস্ত্র ব্যবহার করাও জায়েয।
এ ভিত্তিতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফের যুদ্ধে কাফেরদের উদ্ভাবিত অস্ত্র মিনজানিক (ঐ যুগের কামান) ব্যবহার করেছেন এবং হযরত উমর রা. খলীফা থাকাকালে হযরত আবু মুসা আশআরী রা. কে তুসতার শহরের কেল্লা অবরোধকালে মিনজানিক ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তেমনি হযরত আমর ইবনুল আস রা. যখন আলেকজান্দ্রিয়া শহর অবরোধ করেন তখন তিনি মিনজানিক ব্যবহার করেন। তেমনিভাবে বিষযুক্ত তরবারি ব্যবহারও (অমুসলিম রীতি হওয়া সত্ত্বেও) জায়েয।
এ আলোচনা দ্বারা এ কথাই প্রতীয়মান হয়, যে সকল পদ্ধতি দ্বারা আল্লাহর ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের শত্রুরা নিপাত হয় এবং আল্লাহর দীনের প্রাবল্য ও বিজয় সূচিত হয় সেসব কৌশল ও অস্ত্র ব্যবহারের রীতি শিক্ষা করা আবশ্যক।
এ কারণেই ইসলামী শরী‘আত কোন কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উন্নতিতে বাধা তো প্রদান করেই না, বরং যে সকল প্রযুক্তি ও কারিগরি দ্বারা দেশের উন্নতি ও উন্নয়ন সাধিত হয়, সেগুলো অর্জন করা ফরযে কিফায়া বলে সাব্যস্ত করেছে। সকল ফকীহ ও আলেম এ বিষয়ে মতৈক্য পোষণ করেন।
কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, অমুসলিমদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প ইত্যাদিও অনুসরণীয়। বিশেষত বর্তমান পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও শিল্প-সংস্কৃতির নামে যে নির্লজ্জতা, বেহায়াপনা, নগ্নতা ও অবাধ যৌনাচারের ছড়াছড়ি চলছে, ইসলাম তা মোটেই অনুমোদন করে না। বরং তার কঠোর বিরোধিতা করে। কেননা, এ সকল অপকর্মের দ্বারা স্বভাব-চরিত্রের বিনাশ ও ধ্বংস সাধন, মানবীয় সুকুমারবৃত্তির অপমৃত্যু এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের অধঃপতন বৈ কোনই উপকার সাধিত হয় না।
মুসলিম বাহিনীর প্রস্তুতি
খন্দক যুদ্ধে কাফেরদের মোকাবেলায় মদীনার বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। এ জন্য একে গাযওয়ায়ে আহযাবও বলা হয়। আহযাব (احزاب)‘হিযবুন’(حزب)-এর বহুবচন। এর অর্থ হলো, বহু দল। তেমনিভাবে এতে আত্মরক্ষার জন্য পরিখা খনন করা হয় বিধায় একে খন্দক যুদ্ধও বলা হয়। খন্দক (خندق) অর্থ পরিখা।
শত্রুসৈন্য মদীনার উপকণ্ঠে পৌঁছার পূর্বেই পরিখার খনন কাজ সমাপ্ত হয়ে যায়। এরপর তাদের পৌঁছার পূর্বেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী ও শিশুদের অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত ও নিরাপদ একটি দুর্গে স্থানান্তরিত করলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. কে মদীনার প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হলো।
বিশ্বাসঘাতক ইহুদীদের প্রতি আস্থা স্থাপনের কোন সুযোগই ছিল না। বনু কায়নুকা ও বনু নাযিরকে আগেই মদীনা থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। এখন শুধু রয়ে গিয়েছিল বনু কুরাইযা। আগে তারা কয়েকবার চুক্তিভঙ্গ করে বিশ্বাসঘাতকতার চেষ্টা করেছে। এবারও সেই আশঙ্কা আছে। আর মুনাফিকরা তো আস্তিনের সাপ হিসেবে আছেই। এসব দিক লক্ষ্য করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুর্গের পাহারার জন্য যায়েদ ইবনে হারেসা রা. এর নেতৃত্বে তিনশ সৈন্য এবং মাসলামা ইবনে আসলাম রা. এর নেতৃত্বে দুইশ সৈন্য মোট পাঁচশত সৈন্যকে নিযুক্ত করলেন।
মুসলমানদের মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল তিন হাজার। তার মধ্যে পাঁচশ এখানে মোতায়েন করার পর অবশিষ্ট আড়াই হাজার সৈন্য নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাহাড় পিছনে রেখে পরিখা সামনে রেখে শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যূহ রচনা করলেন।
শত্রুবাহিনীর অবস্থান
সে সময় শত্রুবাহিনীর একটি অগ্রগামী দলকে মদীনার নিকটবর্তী স্থানে দেখা গেল। তারা মুসলিমদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে বলে মনে হলো।
কাফের দলের সরদার আবু সুফিয়ানের ইচ্ছা ছিল, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সে উহুদ প্রান্তরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। সেখানে তার সাথে সাক্ষাত না হওয়ায় সে বাহিনীকে মদীনার দিকে চালিয়ে দেয়।
মদীনার নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছে আবু সুফিয়ানের দল শিবির স্থাপন করলো। আবু সুফিয়ান ও আরো কয়েকটি গোত্র উহুদের নিকটবর্তী এক জায়গায় অবস্থান করতে লাগলো।
শত্রু বাহিনীর সেই ছোট দলটি মদীনার নিকটবর্তী হয়েই মুসলিমদের অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করতে পারলো। তারা সেখানে পৌঁছে সম্পূর্ণ একটি নতুন জিনিস দেখলো। যা ছিল তাদের কল্পনার অতীত। তারা আশ্চর্য হয়ে মূল বাহিনীতে ফিরে গিয়ে অন্যান্য লোকদের এ সংবাদ জানিয়ে দিল। যে শুনলো, সে-ই হতবাক হয়ে গেল। তারা বলাবলি করতে লাগলো, এ তো দেখছি সম্পূর্ণ নতুন পরিকল্পনা। আরব দেশে তো এমন ব্যবস্থা কখনোই দেখা যায়নি!
শত্রুদের সাথে মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলা
কুরাইশদের আগমনের সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে মুসলমানগণ তাদের ঘাঁটিতে সতর্ক হয়ে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৈন্য বাহিনীকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে দিয়েছিলেন। কিছু সৈন্যকে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে পরিখা দেখা-শোনার কাজে নিয়োজিত করেছেন। আর পরিখার যে স্থানটিতে আক্রমণের আশঙ্কা বেশি ছিল সেখানে কিছু সৈন্য পাহারায় নিযুক্ত করে বাকি সৈন্য শত্রুর মোকাবেলায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। এদের সম্মুখভাগকে পরিখার দিকে মুখ করে মোতায়েন করা হয়। হাতে বর্শা, তীর, ধনুক ও কামান নিয়ে তারা সেখানে মোতায়েন রয়েছেন।
ইতোমধ্যে কাফেরবাহিনী সম্মুখে অগ্রসর হলো। এবার উভয়পক্ষই মুখোমুখি। কুরাইশরা পরিখা পার হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। এই ফাঁকে মুসলিমবাহিনী অনবরত তীর বর্ষণ করে কুরাইশ-বাহিনীকে নাজেহাল করে দিল। ফলে তারা পিছু হটতে লাগলো।
এভাবে যুদ্ধ চলতে চলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। অতঃপর দু’পক্ষই যার যার শিবিরে ফিরে গেল।
পরদিন প্রত্যুষেই কুরাইশ বাহিনী পুনরায় পরিখা পার হওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু মুসলিমবাহিনীর সুদৃঢ় প্রতিরোধের মুখে এবারও তারা ব্যর্থ হলো।
এ ব্যর্থতায় হতাশ হয়ে তারা ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলো। ব্যর্থতার বুঝা ঘাড়ে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে তারা তাদের শিবিরে ফিরে গেল।
কাফেররা এবার স্পষ্ট বুঝতে পারলো, তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলেছে। মুসলিমদের মোকাবেলা করা সহজ নয়। ওদিকে হঠাৎ প্রচন্ড ঝড় ও তুফান শুরু হলো। সেই সাথে পড়লো হাড়কাঁপানো শীত। এই শীতে ও ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কাফেরবাহিনী বরফের মত জমে যাচ্ছিল। তাই তারা ক্ষোভে ও ক্রোধে ফেটে পড়ছিল।
একদিকে বিরূপ আবহাওয়া, অন্যদিকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভূতপূর্ব রণকৌশল কুরাইশদের এই অভিযান ব্যর্থ করে দিল। হতাশার কালো মেঘ কুরাইশবাহিনীকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলো, এখন মুহাম্মাদকে কীভাবে পরাজিত করা সম্ভব?
শত্রুদের ভিন্ন পথ অবলম্বন
কাফের বাহিনীর নৈরাশ্যকর অবস্থার মুখে বনী নাযিরের সরদার হুয়াই বিন আখতাব আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লো। সেনাসংগ্রহের জন্য সে-ই সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী ছিল। মানসিকভাবে সে খুব ভেঙ্গে পড়লো। সে ভীষণ ঘাবড়ে গেল।
অবশেষে হুয়াই চিন্তা করলো, সৈন্যরা যদি হতাশার কারণে বিদ্রোহ করে, তা হলে কী উপায় হবে? তখন তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। সে জন্য অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
এ কথা চিন্তা করে সে আবু সুফিয়ানের কাছে এসে বললো, আমি চেষ্টা করলে মদীনায় বসবাসকারী বনু কুরাইযাকে মুহাম্মাদের সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করিয়ে আমাদের সাথে নিতে পারি। আর তুমি তো জানো, তাদের শক্তি ও সাহস কোন পর্যায়ের। আমার এ চেষ্টা সফল হলে মদীনার অভ্যন্তরে পৌঁছাও সহজ হয়ে যাবে। আবু সুফিয়ান বললো, তা হলে আর দেরি না করে যাও। গিয়ে বলো, মুহাম্মাদের সাথে শান্তি চুক্তি ভেঙ্গে দাও।
হুয়াই কালবিলম্ব না করে বনু কুরাইযার দিকে ছুটলো। বনু কুরাইযার সরদার কা‘ব হুয়াইয়ের আগমনসংবাদ শুনেই দুর্গের দরজা বন্ধ করে দিল। সে তার মতলব টের পেয়ে গিয়েছিল। তাই তার সাথে সাক্ষাত করাটা মোটেই পছন্দ করলো না।
হুয়াই দুর্গের দরজায় পৌঁছে আওয়াজ দিল এবং দরজা খোলার জন্য বললো। আর সবাইকে আশ্বস্ত করার উদ্দেশে বললো, আমি জানি, তোমরা কেন দরজা বন্ধ করেছ। তোমরা ভাবছো, যদি আমি তোমাদের খাস পেয়ালায় শরীক হয়ে যাই! তার এ কথায় কা‘ব লজ্জা পেল। তখন দরজা খুলে দিল।
হুয়াই বললো, দেখ কা‘ব, আমি তোমার জন্য কত বড় মর্যাদাকর সুসংবাদ নিয়ে এসেছি। সমুদ্রের মত বিশাল এক বাহিনী নিয়ে এসেছি। সারা আরবভূমি উজাড় হয়ে এসেছে। কুরাইশ ও গাতফান গোত্রের সমস্ত নেতাও এসেছেন। সবার একটাই লক্ষ্য, তারা মুহাম্মাদের রক্ত পান করতে চায়। সবাই একমত যে, মুহাম্মাদকে সদলবলে নির্মূল করা ছাড়া শান্তির কোন পথ নেই।
কা‘ব বললো, তুমি আমাকে বেইজ্জত করতে চাচ্ছ। আমি মুহাম্মাদের সাথে শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ। এ চুক্তি ভঙ্গ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মুহাম্মাদ সর্বদাই আমাদের সাথে চুক্তির শর্ত মেনে চলছে।
হুয়াই তবু দমলো না। সে বারবারই কা‘বের মন গলানোর চেষ্টা করতে লাগলো। সে বললো, সম্প্রদায়ের সমস্ত মানুষের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব এখন তোমার হাতে। তাদের ইজ্জত-সম্ভ্রমও তোমারই হাতে। তুমি একটু চিন্তা করে দেখো। এ সুযোগ হাতছাড়া করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তুমি মুহাম্মাদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করো এবং সৈন্যদের যাওয়ার রাস্তা দিয়ে দাও। তারা বন্যার মতো প্রবেশ করবে এবং মুহাম্মাদ ও তার বাহিনীকে নির্মূল করে দেবে। তারপর সমগ্র আরবে আবার আমাদের আধিপত্য বিস্তার হবে। আমাদের ধর্মও নিষ্কণ্টক হয়ে যাবে। মদীনার সমস্ত ধনসম্পদ আর জমি-জায়গাও আমাদের অধিকারে এসে যাবে।
এবারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো না। হুয়াইর বক্তব্য যাদুর মতো কাজ হলো। কা‘ব তার মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে চুক্তি ভঙ্গ করতে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু তবু সে চিন্তা করতে লাগলো যে, কুরাইশ ও গাতফানদের সম্মিলিত বাহিনী যদি পরাজিত হয়, তাহলে কী দশা হবে? তারা তো নিজেদের বাঁচানোর জন্য তখন অন্য পথ ধরবে। আর আমরা একাকী হয়ে যাব। তখন আমাদের কী অবস্থা হবে? বনু নাযির ও বনু কায়নুকার মতোই পরিণাম আমাদের ভোগ করতে হবে।
তখন হুয়াই এ প্রশ্নেরও সমাধান দিয়ে দিল। হুয়াই বললো, আল্লাহ না করুন, আমরা যদি হেরে যাই, আর কুরাইশরা যদি রণক্ষেত্র ত্যাগ করে পালিয়ে যায়, তা হলে আমি খায়বার ছেড়ে এসে তোমাদের সাথে বসবাস করবো। বিপদ আপদে সর্বদাই আমরা তোমাদের সাথে থাকবো।
এবার কা‘ব পুরোপুরিভাবে তার পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেললো। সে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কৃত চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে শত্রু বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।
হুয়াই আনন্দচিত্তে আপন বাহিনীতে গিয়ে এ সংবাদ জানিয়ে দিল। এবার তারা ভাবতে লাগলো, জয় আমাদের সুনিশ্চিত। কেবল বনু কুরাইযারই আগমনের অপেক্ষা।
পরিবর্তিত পরিস্থিতি: মুসলিম বাহিনী কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন
বনী কুরাইযার বিদ্রোহের এই সংবাদ খুব দ্রুত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছে গেল। তিনি খবরটির সত্যতা যাচাই করার জন্য এবং এ নিয়ে সরাসরি বনু কুরাইযার সরদার কা‘বের সাথে কথা বলার জন্য সা‘দ ইবনে মুয়ায, সা‘দ ইবনে উবাদাহ ও আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা- এই তিনজন সাহাবীকে পাঠালেন। তাদের বলে দিলেন, যদি খবরটি সঠিক বলে প্রমাণিত হয়, তা হলে ফিরে এসে তোমরা খবরটি এমন অস্পষ্ট ভাষায় জানাবে যেন উপস্থিত লোকজন তা অনুধাবন করতে সক্ষম না হয়। আর যদি খবরটি সঠিক না হয়, তাহলে সকলের মাঝে সুস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করতে কোন অসুবিধা নেই।
তখন তারা বিষয়টির সত্যতা জানতে পেরে বনু কুরাইযার সরদার কা‘ব ইবনে আসাদের সাথে সাক্ষাত করে মুসলিমদের সাথে তার পূর্বকৃত ওয়াদার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে কা‘ব বললো, কিসের ওয়াদা! আর মুহাম্মাদই-বা কে! তার সাথে আমাদের কোন ওয়াদা-অঙ্গীকার নেই।
তখন এই তিন সাহাবী ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ মত অস্পষ্ট শব্দে তাকে এই সংবাদ জানালেন। তারা বললেন, ‘আদল ও ফারাহ। অর্থাৎ ‘আদল ও ফারাহ গোত্র আসহাবুর রাজি তথা খুবাইব রা.-এর সাথে যেমন ওয়াদা ভঙ্গ করেছে, বনী কুরাইযাও তদ্রুপ ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২:৪০ পৃষ্ঠা)
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু কুরাইযার এই বিশ্বাসঘাতকতার কারণে খুবই ব্যথিত হলেন। কেননা, এখন মদীনা অরক্ষিত হয়ে গেল। মালপত্র পৌঁছানোর রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেল। শত্রুদের মদীনায় আক্রমণের পথ খুলে গেল। মুসলমানগণ এখন বাহির-ভিতর সবদিক থেকে শত্রুর বেষ্টনীর মধ্যে পড়ে গেলেন। মুসলমানগণ বর্ণনাতীত নাযুক ও ভয়াবহ অবস্থায় পড়ে গেলেন।
আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে যুদ্ধের এ পরিস্থিতি ও মুসলিমদের অবস্থা বর্ণনা করে ইরশাদ করেন,
اِذْ جَآءُوْكُمْ مِّنْ فَوْقِكُمْ وَ مِنْ اَسْفَلَ مِنْكُمْ وَ اِذْ زَاغَتِ الْاَبْصَارُ وَ بَلَغَتِ الْقُلُوْبُ الْحَنَاجِرَ وَ تَظُنُّوْنَ بِاللهِ الظُّنُوْنَا○هُنَالِکَ ابْتُلِیَ الْمُؤْمِنُوْنَ وَ زُلْزِلُوْا زِلْزَالًا شَدِیْدًا○
ঐ সময়ের কথা স্মরণ করো, যখন কাফেররা তোমাদের বিরুদ্ধে সমাগত হয়েছিল উঁচু এলাকা ও নিম্ম এলাকা থেকে এবং যখন তোমাদের চোখ (বিস্ময়ে) বিস্ফোরিত হয়েছিল, তোমাদের প্রাণ হয়ে পড়েছিল কণ্ঠাগত। আর তোমরা আল্লাহর সম্বন্ধে নানা (অমূলক) ধারণা করছিলে। তখন মুমিনগণ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল এবং তারা ভীষণ কম্পিত হয়েছিল। (সূরা আহযাব, আয়াত:১০-১১)
সময়টি ছিল মুসলিমদের জন্য বড় কঠিন পরীক্ষার। ইখলাস ও নিখাঁদ দীনের কষ্টিপাথর দ্বারা ঈমান ও নেফাক যাচাই করা হচ্ছিল। এ কষ্টিপাথর তখন খাঁটি ও ভেজালের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়।
মুনাফিকদের প্রতারণা ও পলায়ন
এ বহু মুনাফিক গোপনে পলায়ন করে। অনেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আবেদন জানায়, আল্লাহর রাসূল, আমাদের ঘরের দেয়াল খুব নিচু, তাই ঘরগুলো মোটেই সংরক্ষিত নয়। মহিলা ও শিশুদের হেফাজত করা জরুরী। তাই আপনার কাছে যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি কামনা করছি। এ জাতীয় নানান মিথ্যা অজুহাত পেশ করে মুনাফিকরা ময়দান ছাড়তে লাগলো। অধিকন্তু শুধু নিজেরা নয়, সত্যিকার মুমিনদেরও ময়দান ত্যাগ করার জন্য বিভিন্ন কথা বলে তারা ফুসলাতে লাগলো। এহেন নাজুক মুহূর্তে তাদের এই ঘৃণ্য তৎপরতা আল্লাহ তা‘আলার কাছে এত অপছন্দ হয়েছিল যে, আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের নয়টি আয়াতে তাদের এই ঘৃণ্য অপতৎপরতার বর্ণনা তুলে ধরেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
وَ اِذْ یَقُوْلُ الْمُنٰفِقُوْنَ وَالَّذِیْنَ فِیْ قُلُوْبِهِمْ مَّرَضٌ مَّا وَعَدَنَا اللهُ وَ رَسُوْلُهٗۤ اِلَّا غُرُوْرًا○وَ اِذْ قَالَتْ طَّآئِفَۃٌ مِّنْهُمْ یٰۤاَهْلَ یَثْرِبَ لَا مُقَامَ لَكُمْ فَارْجِعُوْا ۚ وَیَسْتَاْذِنُ فَرِیْقٌ مِّنْهُمُ النَّبِیَّ یَقُوْلُوْنَ اِنَّ بُیُوْتَنَا عَوْرَۃٌ ؕۛ وَمَا هِیَ بِعَوْرَۃٍ ۚۛ اِنْ یُّرِیْدُوْنَ اِلَّا فِرَارًا○وَلَوْ دُخِلَتْ عَلَیْهِمْ مِّنْ اَقْطَارِهَا ثُمَّ سُئِلُوا الْفِتْنَۃَ لَاٰتَوْهَا وَمَا تَلَبَّثُوْا بِهَاۤ اِلَّا یَسِیْرًا○وَلَقَدْ کَانُوْا عَاهَدُوا اللهَ مِنْ قَبْلُ لَا یُوَلُّوْنَ الْاَدْبَارَ ؕ وَکَانَ عَهْدُ اللهِ مَسْـُٔوْلًا○قُلْ لَّنْ یَّنْفَعَكُمُ الْفِرَارُ اِنْ فَرَرْتُمْ مِّنَ الْمَوْتِ اَوِ الْقَتْلِ وَ اِذًا لَّا تُمَتَّعُوْنَ اِلَّا قَلِیْلًا○قُلْ مَنْ ذَا الَّذِیْ یَعْصِمُكُمْ مِّنَ اللهِ اِنْ اَرَادَ بِكُمْ سُوْٓءًا اَوْ اَرَادَ بِكُمْ رَحْمَۃً ؕ وَلَا یَجِدُوْنَ لَهُمْ مِّنْ دُوْنِ اللهِ وَلِیًّا وَّلَا نَصِیْرًا○قَدْ یَعْلَمُ اللهُ الْمُعَوِّقِیْنَ مِنْكُمْ وَ الْقَآئِلِیْنَ لِاِخْوَانِهِمْ هَلُمَّ اِلَیْنَاۚ وَلَا یَاْتُوْنَ الْبَاْسَ اِلَّا قَلِیْلًا○اَشِحَّۃً عَلَیْكُمْۚۖ فَاِذَا جَآءَ الْخَوْفُ رَاَیْتَهُمْ یَنْظُرُوْنَ اِلَیْکَ تَدُوْرُ اَعْیُنُهُمْ کَالَّذِیْ یُغْشٰی عَلَیْهِ مِنَ الْمَوْتِ ۚ فَاِذَا ذَهَبَ الْخَوْفُ سَلَقُوْكُمْ بِاَلْسِنَۃٍ حِدَادٍ اَشِحَّۃً عَلَی الْخَیْرِؕ اَولٰٓئِکَ لَمْ یُؤْمِنُوْا فَاَحْبَطَ اللهُ اَعْمَالَهُمْ ؕ وَکَانَ ذٰلِکَ عَلَی اللهِ یَسِیْرًا○یَحْسَبُوْنَ الْاَحْزَابَ لَمْ یَذْهَبُوْا ۚ وَ اِنْ یَّاْتِ الْاَحْزَابُ یَوَدُّوْا لَوْ اَنَّهُمْ بَادُوْنَ فِی الْاَعْرَابِ یَسْاَلُوْنَ عَنْ اَنْۢبَآئِكُمْ ؕ وَلَوْ کَانُوْا فِیْكُمْ مَّا قٰتَلُوْۤا اِلَّا قَلِیْلًا○
স্মরণ করুন, মুনাফিকরা ও যাদের অন্তরে ছিল ব্যাধি, তারা বলছিল, আল্লাহ ও তার রাসূল আমাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা প্রতারণা ব্যতীত কিছুই নয়। আর তাদের একদল বলেছিল, হে ইয়াসরিববাসী, এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই। তোমরা ফিরে যাও। আর তাদের একদল নবীর কাছে অব্যাহতি প্রার্থনা করে বলছিল, আমাদের বাড়ি-ঘর অরক্ষিত। অথচ এগুলো অরক্ষিত ছিল না। আসলে পলায়ন করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। যদি বিভিন্ন দিক থেকে তাদের (মুসলমানদের) বিরুদ্ধে শত্রুদের প্রবেশ ঘটতো, অতঃপর তাদের (মুনাফিকদের) বিদ্রোহের জন্য প্ররোচিত করা হতো, তবে তারা অবশ্যই তা করে বসতো। তারা এতে কালবিলম্ব করতো না। এরা তো পূর্বেই আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার করেছিল যে, তারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে না। আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার সম্বন্ধে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে। বলুন, তোমাদের কোন লাভ হবে না যদি তোমরা মৃত্যু অথবা হত্যার ভয়ে পলায়ন করো। তবে সেক্ষেত্রে তোমাদের সামান্যই ভোগ করতে দেওয়া হবে। বলুন, কে তোমাদের আল্লাহ হতে দূরে রাখবে যদি তিনি তোমাদের অমঙ্গল ইচ্ছা করেন অথবা তিনি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করার ইচ্ছা করেন? তারা আল্লাহ ব্যতীত নিজেদের কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না। আল্লাহ অবশ্যই জানেন, তোমাদের মধ্যে কারা বাধা প্রদানকারী এবং কারা তাদের ভাইদের বলে, আমাদের সাথে আসো। তারা অল্পই যুদ্ধে অংশ নেয়। তোমাদের ব্যাপারে বিরাগবশত; আর যখন ভীতি আসে, তখন আপনি তাদের দেখবেন, মৃত্যুর ভয়ে মূর্ছাতুর ব্যক্তির মতো চক্ষু উল্টিয়ে তারা আপনার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু যখন ভীতি চলে যায়, তখন তারা ধনের লালসায় তোমাদের তীক্ষ্ণ ভাষায় বিদ্ধ করে। তারা ঈমান আনেনি, এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাদের আমলসমূহকে নিষ্ফল করে দিয়েছেন। আর এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ। তারা সম্মিলিত বাহিনীকে ধারণা করে, তারা যায়নি। যদি সম্মিলিত বাহিনী আবার এসে পড়ে, তখন তারা কামনা করবে, ভালো হতো তারা যদি যাযাবর মরুবাসীদের সাথে থেকে তোমাদের সংবাদ নিত। তারা তোমাদের সাথে অবস্থান করলেও যুদ্ধ খুব কমই করতো। (সূরা আহযাব, আয়াত:১২-২০)
এ সব আয়াতে গাযওয়ায়ে আহযাব বা খন্দকের জিহাদের সময় মুনাফিকদের স্বার্থান্ধ ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এবং এর দায় ও পরিণাম সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। তারা খুবই সুবিধাবাদী হয়। যখন মুসলিমদের ভাল অবস্থা দেখে, তখন এসে ভাগ বসাতে চায়। আবার যখন সঙ্গীন অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তখন সেখান থেকে পলায়ন করতে চায়। উল্লিখিত ঘটনায় তাদের সেই দু’রকম চেহারা সম্যকরূপে প্রকাশ পেয়েছে।
অপরদিকে যারা ঈমান ও ইখলাসে পরিপূর্ণ, যাদের অন্তর ছিল আল্লাহ ও তার রাসূলের মুহাব্বতে পূর্ণ, গাযওয়ায়ে আহযাবের সময় তাদের ভূমিকা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَمَّا رَاَ الْمُؤْمِنُوْنَ الْاَحْزَابَ ۙ قَالُوْا هٰذَا مَا وَعَدَنَا اللهُ وَ رَسُوْلُهٗ وَ صَدَقَ اللهُ وَ رَسُوْلُهٗ ۫ وَمَا زَادَهُمْ اِلَّاۤ اِیْمَانًا وَّ تَسْلِیْمًا○
মুমিনরা যখন সম্মিলিত বাহিনী দেখলো, তখন তারা বলে উঠলো, এটি তো তা-ই, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল আমাদের নিকট যার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তার রাসূল সত্যই বলেছেন। এর দ্বারা তাদের ঈমান ও আনুগত্যই বৃদ্ধি পেল। (সূরা আহযাব, আয়াত:২২)
এ আয়াতে গাযওয়ায়ে আহযাবে মুমিনদের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে। তারা সেই জিহাদকে আল্লাহর দীনের বিজয়ের অবলম্বনরূপে গ্রহণ করেছিলেন।