গাযওয়ায়ে বদর
আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের সূরা আনফালে ইরশাদ করেন,
کَمَاۤ اَخْرَجَکَ رَبُّکَ مِنْۢ بَیْتِکَ بِالْحَقِّ ۪ وَ اِنَّ فَرِیْقًا مِّنَ الْمُؤْمِنِیْنَ لَکٰرِهُوْنَ○ یُجَادِلُوْنَکَ فِی الْحَقِّ بَعْدَ مَا تَبَیَّنَ کَاَنَّمَا یُسَاقُوْنَ اِلَی الْمَوْتِ وَهُمْ یَنْظُرُوْنَ○
(গনিমতের মাল বণ্টনের এ বিষয়টা কল্যাণকর হওয়ার দিক থেকে এমনই) যেমন আপনাকে আপনার রব আপনার ঘর (মদীনা) থেকে (বদরপ্রান্তরে) বের করেছেন ন্যায় ও সৎকাজের (কাফেরদের সাথে যুদ্ধের) জন্য, আর মুমিনদের একটি দল (সংখ্যা স্বল্পতা আর যুদ্ধাস্ত্রের স্বল্পতার কারণে স্বভাবত) তা অপছন্দ করছিল। তারা আপনার সাথে বিবাদ করছিল সত্য ও ন্যায় বিষয়ে (তথা কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করার ব্যাপারে) (মশওয়ারা সাপেক্ষে) তা (যুদ্ধের সিদ্ধান্ত) প্রকাশিত হওয়ার পর। (তারা আপনার সাথে এমনভাবে বিবাদ করছিল) যেন তাদেরকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আর তারা (মৃত্যুকে) দেখছে। (সূরা আনফাল, আয়াত:৫-৬; তাফসীরে মারিফুল কুরআন, ৪/১৮১)
এ আয়াত দুটিতে গাযওয়ায়ে বদর প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামের ইতিহাসে গাযওয়ায়ে বদর বা বদরের যুদ্ধ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই যুদ্ধ দ্বারা একদিকে তখনকার ইসলাম বিরোধী কুফরী শক্তির দর্প চূর্ণ হয়েছে। অপরদিকে মুসলিমগণ মানসিকভাবে অশেষ দৃঢ়তা অর্জন করতে পেরেছেন। আল্লাহ তা‘আলা এই যুদ্ধের মাধ্যমে হক ও বাতিলের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য রচনা করে দিয়েছেন। এই যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ঘটনার প্রতি গভীরভাবে মনোযোগ দিলে মুমিনের ঈমান বাড়ে আর অবিশ্বাসী সম্প্রদায় এর দ্বারা ইসলাম গ্রহণ করার এবং ইসলামের বিরোধিতা না করার নসীহত লাভ করতে পারে।
অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের নসীহত অর্জনের মতো আরেকটি যুদ্ধ হলো গাযওয়ায়ে খায়বার। এ যুদ্ধেও ইসলাম বিরোধীদের নাস্তানাবুদ হওয়ার চিত্র প্রত্যক্ষভাবে ফুটে উঠেছে।
আমরা সবিস্তারে এই দুই গাযওয়া সম্পর্কিত আয়াতগুলোর তাফসীর করার চেষ্টা করবো। যাতে মুসলিমগণের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা যেন আল্লাহ তা‘আলার রহমত থেকে নিরাশ না হয় আর অবিশ্বাসী সম্প্রদায় নসীহত অর্জনপূর্বক ইসলামের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকে।
প্রথমে বদর যুদ্ধের প্রসঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। এ যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট দুটি আয়াত উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতে বলা হয়েছে,
وَ اِنَّ فَرِیْقًا مِّنَ الْمُؤْمِنِیْنَ لَکٰرِهُوْنَ
“মুমিনদের একটি দল তা অপছন্দ করছিল।”
সাহাবায়েকেরামের একটি দল বদর যুদ্ধকে কেন অপছন্দ করছিলেন, তা বুঝার জন্য বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট জানা প্রয়োজন।
গাযওয়ায়ে বদরের প্রেক্ষাপট
ইবনে উকবা ও ইবনে আমেরের বর্ণনা মোতাবেক বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিম্নরূপ।
কাফেররা বিভিন্নভাবে ইসলামের ধ্বংস সাধনের অপচেষ্টা করতে থাকে। তাদের অত্যাচারে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবীগণ মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। কিন্তু তাদের মদীনায় চলে আসার পরও কাফেররা ইসলাম ও মুসলিমদের ধ্বংস সাধনে নানারকম ষড়যন্ত্র করতে থাকে।
ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে সেই ষড়যন্ত্রের সূত্রেই কাফেররা মক্কা থেকে সিরিয়ায় একটি বৃহৎ বাণিজ্য-কাফেলা প্রেরণ করে। যার উদ্দেশ্য ছিলো, ব্যবসার মুনাফা লব্ধ অর্থসম্পদ তারা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যয় করবে। এমনকি এ ব্যাপারে তারা মান্নত করে নিলো।
তাদের এ অসৎ পরিকল্পনার কথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জেনে গেলেন। তাই তাদের সেই চক্রান্তমূলক বাণিজ্য-কাফেলার গতিরোধ করার ইচ্ছা করলেন।
দ্বিতীয় হিজরির রমযান মাস চলছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হঠাৎ একদিন খবর পেলেন, কুরাইশ-সরদার আবু সুফিয়ান মক্কার সেই বৃহৎ ব্যবসায়ী কাফেলা নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করছে। এই ব্যবসায় মক্কার সমস্ত কুরাইশ শরীক ছিল। এই কাফেলায় তখনকার পঞ্চাশ হাজার দিনার সমমূল্যের মাল ছিল। বর্তমান টাকার হিসেবে পঞ্চাশ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এই ব্যবসায়ী কাফেলার হেফাজতের জন্য কুরাইশের সত্তরজন সশস্ত্র জওয়ান পাহারায় নিযুক্ত ছিল। এদের চল্লিশজনই ছিল নেতা পর্যায়ের। তাদের মধ্য থেকে আমর ইবনুল আস ও মাখযামা বিন নাওফেল-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
যদিও ব্যবসা ছিল কুরাইশদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু এই ব্যবসায়ী কাফেলার মাধ্যমে তারা বিশেষভাবে অর্থসম্পদ ও যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ করে ইসলামের বিরুদ্ধাচরণে অবতীর্ণ হওয়ার শপথ করেছিলো এবং এই কাফেলার সমস্ত মাল তারা ইসলাম ও মুসলিমদের উৎখাতের জন্য ব্যয় করার মান্নত করে রেখেছিল।
তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এই ব্যবসায়ী কাফেলার সিরিয়া থেকে মক্কার পথে রওনা হওয়ার কথা শুনলেন, তখন তিনি কুরাইশদের এই ইসলাম বিরোধী অপতৎপরতার ভিত উপড়ে ফেলার জন্য এই কাফেলার গতিরোধ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন।
এ নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত সাহাবায়েকেরামের সাথে পরামর্শ করলেন। তখন একে তো রমযান মাস চলছিল, তা ছাড়া পূর্ব থেকে তাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি ছিল না, তাই এ ব্যাপারে কেউ কেউ কিছুটা অমত প্রকাশ করেছিলেন। আবার কেউ কেউ খুব বাহাদুরির সাথে হামলার পক্ষে মত ব্যক্ত করেছিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে এই জিহাদে শরীক হওয়ার হুকুম দিলেন না। বরং বললেন, যারা যেতে আগ্রহী এবং যাদের বাহন-জন্তু এ এলাকায় উপস্থিত আছে, শুধু তারাই আমার সাথে যুদ্ধে বের হবে।
এ কথা শুনে অনেকেই এ জিহাদে শরীক হলেন না। কারণ, তারা ভাবছিলেন, ব্যবসায়ী কাফেলার গতিরোধ করা হবে। এর জন্য বেশি সংখ্যক মুজাহিদের প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধে শরীক হওয়াকে জরুরী বলেননি। বরং ঐচ্ছিক বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
অনেকে যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছায় বাহন-জন্তু গ্রাম থেকে নিয়ে আসার অনুমতি চাইলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুমতি দিলেন না। কারণ, হাতে এতটা সময় ছিল না যে, তাদের জন্য অপেক্ষা করা হবে। এসব কারণে খুব কম সংখ্যক সাহাবী এ যুদ্ধে শরীক হয়েছিলেন।
যুদ্ধের উদ্দেশ্যে কাফেলা রওনা হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়েকেরামকে নিয়ে মদীনার বাইরে ‘বিরে সুকআ’ নামক স্থানে পৌঁছলেন। কায়েস বিন সা‘সা রা. কে সৈন্য সংখ্যা গণনা করার হুকুম দিলেন। তিনি জানালেন, সৈন্য সংখ্যা সব মিলে ৩১৩। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তালুতের বাহিনীর সৈন্য সংখ্যাও ৩১৩ জন ছিল। এর দ্বারা বিজয়ের শুভ লক্ষণ গ্রহণ করা যেতে পারে।
সাহাবায়ে কেরামের সাথে মোট সত্তরটি উট ছিল। পালাক্রমে প্রত্যেক তিনজন একটি উটে আরোহণ করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গী ছিলেন হযরত আলী ও আবু লুবাবা রা.। যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পায়ে হেঁটে চলার পালা আসতো, তখন তারা বলতেন, আপনার পরিবর্তে আমরাই হেঁটে চলছি, আপনি উটের উপর থাকুন। উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, তোমরা আমার চেয়ে বেশি শক্তিশালী নও, আর আমি আখিরাতের সাওয়াব থেকে অমুখাপেক্ষী নই যে, নিজের সুযোগ হাতছাড়া করবো। এ জবাবের পর কিছু বলার থাকে না। তাই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামও নিজের পালার সময় পায়ে হেঁটে চলতে লাগলেন।
ওদিকে একব্যক্তি সিরিয়ার প্রসিদ্ধ স্থান আইনে যারকা পৌঁছে কাফেলা-প্রধান আবু সুফিয়ানকে সতর্ক করলো। সে সংবাদ দিল, মুহাম্মাদ অস্ত্রশস্ত্র ও দলবল নিয়ে তার অপেক্ষায় আছেন।
এই সংবাদ শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পাকড়াও থেকে বাঁচার জন্য আবু সুফিয়ান ভিন্ন পথে অগ্রসর হলো এবং হিজাযের সীমানায় প্রবেশ করে যামযাম বিন উমর নামক এক বিচক্ষণ ও দ্রুতগামী দূতকে অনেক সম্পদের বিনিময়ে মক্কার সরদারের নিকট এই মর্মে সংবাদ দিয়ে পাঠালো যে, ব্যবসায়ী কাফেলা মুসলিম ফৌজ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। অনতি বিলম্বে ব্যবস্থা নিন।
যামযাম বিন উমর ব্যবসায়ী কাফেলার আশঙ্কা বুঝানোর জন্য ঐ সময়ের বিশেষ রীতি অনুযায়ী মক্কায় প্রবেশের পূর্বে নিজ উটের নাক-কান কেটে দিল এবং পরিধেয় বস্ত্র অগ্র-পশ্চাৎ থেকে ছিঁড়ে ফেললো। আর উটের হাওদা উল্টিয়ে উটের পিঠে রেখে দিল। যখন সে এই অবস্থায় মক্কায় প্রবেশ করলো, তখন মুহূর্তে তার সংবাদ মক্কার অলিগলিতে পৌঁছে গেল এবং তার নিকট বিস্তারিত খবর শোনার পর কুরাইশের শত শত যুবক মুসলিমদের হাত থেকে তাদের ব্যবসায়ী কাফেলা রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।
কুরাইশের সামর্থ্যবানরা নিজেরাই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। আর যারা দুর্বল বা সমস্যাগ্রস্ত ছিল, তারা নিজেদের পক্ষ থেকে আরেকজনকে পাঠানোর ব্যবস্থা করলো। মাত্র তিন দিনের মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র ও প্রয়োজনীয় যুদ্ধসামগ্রী নিয়ে হাজার সৈনিকের একটি দল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলো। তাদের মধ্যে ছিল এক হাজার যোদ্ধা, দুইশত ঘোড়া এবং ছয়শত উট ও বাদক দল।
এসব নিয়ে কাফের বাহিনী মদীনা অভিমুখে যাত্রা শুরু করলো। প্রত্যেক মনযিলে (ষোল মাইলে এক মনযিল) এ বাহিনীর খাবারের জন্য দশটি করে উট জবাই করতে হতো।
এ যুদ্ধে যেতে যে-ই পিছপা হচ্ছিল, কুরাইশ-সরদার তাকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো। তা ছাড়া যেসব লোকের ব্যাপারে কুরাইশদের ধারণা ছিল, তারা মুসলিমদের সহমর্মী এবং ঐসব মুসলমান, যারা বিভিন্ন ওজরের কারণে তখনও পর্যন্ত হিজরত করতে পারেননি, তাদের এবং বনী হাশেমের মধ্য থেকে যার ব্যাপারে সামান্য ধারণা হলো যে, সে মুসলিমদের ব্যাপারে নরম মনোভাব রাখে, তাদেরও জোরপূর্বক এই যুদ্ধে শরীক করে নেওয়া হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা আব্বাস রা. এবং আবু তালিবের দুই ছেলে তালিব ও আকিল এই অপারগদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
এ দিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু একটি ব্যবসায়ী কাফেলাকে ধাওয়া করার প্রস্তুতির নিয়তে রমাযানের ১২ তারিখে মদীনা থেকে বের হয়েছেন। মক্কার কাফেরদের পূর্ণ যুদ্ধ প্রস্তুতির কথা তারা জানতেন না, তাই তাদের মোকাবেলায় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ প্রস্তুতি তাদের ছিল না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৩১৩ জন সাহাবীকে নিয়ে কয়েক মনযিল পথ অতিক্রম করে বদরের নিকটবর্তী একস্থানে পৌঁছলেন। সেখানে পৌঁছে আবু সুফিয়ানের কাফেলার সংবাদ নেওয়ার জন্য দুই ব্যক্তিকে পাঠালেন। গুপ্তচররা এই সংবাদ নিয়ে এলেন যে, মুসলিমদের পিছু ধাওয়া করার সংবাদ পেয়ে আবু সুফিয়ান সমুদ্র সৈকতের পথ ধরে মক্কায় পৌঁছে গেছে আর মক্কা থেকে এক হাজারের এক বাহিনী মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মদীনার দিকে আসছে।
গুপ্তচরের এ সংবাদ পরিস্থিতি পাল্টে দিলো। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়েকেরামের সাথে পরামর্শে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কুরাইশদের আগত বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করবো নাকি তাদের এড়িয়ে যাবো?
হযরত আবু আইয়ুব আনসারীসহ কয়েকজন সাহাবী বললেন, তাদের সাথে যুদ্ধ করার মতো সামর্থ্য বর্তমানে আমাদের নেই। তাছাড়া আমরা সমরাস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার নিয়তে বা সেই রকম প্রস্তুতি নিয়ে বের হইনি।
তাদের কথা শেষ হওয়ার পর হযরত আবুবকর রা. দাঁড়ালেন এবং যে কোনো পরিস্থিতিতে যে কোনো হুকুম বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে পেশ করলেন। এরপর হযরত উমর রা. ও যে কোন নির্দেশ পালনের জন্য নিজেদের মানসিক প্রস্তুতির কথা জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কথা শুনে খুশি হলেন এবং তাদের জন্য দু‘আ করলেন।
কিন্তু তখন পর্যন্ত আনসারী সাহাবীগণের পক্ষ থেকে যুদ্ধের জন্য সম্মতিসূচক কোন কথা পাওয়া যায়নি। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় বললেন, তোমরা আমাকে পরামর্শ দাও, এ জিহাদে অগ্রসর হবো, নাকি হবো না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মূলত আনসারী সাহাবীগণকে লক্ষ্য করেই এ কথা বলেছিলেন। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আনসারদের সরদার সাদ বিন মুয়ায রা. বললেন, আল্লাহর রাসূল, আমরা আপনার উপর ঈমান এনেছি এবং এ সাক্ষ্য দিয়েছি যে, আপনি যা বলেন তা সব সত্য ও সঠিক। আর আমরা আনসারীগণ আপনার সাথে এই অঙ্গীকার করেছি যে, আমরা সর্বাবস্থায় আপনাকে মান্য করবো। অতএব, আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে যে হুকুম দিয়েছেন, তা আপনি নিশ্চিন্তে জারি করুন। শপথ ঐ সত্তার, যিনি আপনাকে সত্য দীন দিয়ে পাঠিয়েছেন, যদি আপনি আমাদের উত্তাল সমুদ্রতরঙ্গে ঝাঁপ দিতে বলেন, তবু আমরা পিছপা হবো না। কালই যদি আপনি আমাদের শত্রুবাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন, তবু আমাদের কোন দ্বিধা থাকবে না। আমরা আশা করছি, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের দ্বারা এমন অবস্থার সৃষ্টি করবেন, যা দেখে আপনার চক্ষু শীতল হবে। আপনি যেখানে চান আমাদের নিয়ে চলুন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদ রা. এর দৃপ্তকণ্ঠের আত্মপ্রত্যয়ী কথা শুনে দারুণ খুশি হলেন। কাফেলাকে হুকুম দিলেন, আল্লাহর নামে সামনে অগ্রসর হও। আর সাহাবীগণকে এ সুসংবাদ দিলেন যে, আল্লাহ তা‘আলা দুই দলের (আবু সুফিয়ানের ব্যবসায়ী কাফেলা ও আবু জাহেলের নেতৃত্বাধীন কুরাইশ সেনাবাহিনীর) মধ্য থেকে যেকোনো একটির উপর বিজয় দানের ওয়াদা করেছেন। (তাফসীরে মারিফুল কুরআন, ৪/১৮৭)
উক্ত বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আয়াতে বর্ণিত ‘আর মুমিনদের একটি দল অপছন্দ করছিল’-এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, হযরত আবু আইয়ূব আনসারীসহ কিছু সাহাবীর পূর্ণ যুদ্ধপ্রস্তুতি না থাকায় এতে অমত পোষণ করা। আর এ বিষয়টিই পরবর্তী আয়াতে ‘তারা আপনার সাথে বিবাদ করছিল সত্য ও ন্যায় বিষয়ে’ দ্বারা ব্যক্ত করা হয়েছে।
যদিও সাহাবীগণ কখনো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কোন বিষয়ে ঝগড়া-বিবাদ করেননি, কিন্তু যুদ্ধের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মানশা বা ইচ্ছা বুঝার পরও তার ইচ্ছার বিপরীত খেয়াল প্রকাশ করা সাহাবায়েকেরামের উঁচু মর্যাদা অনুযায়ী হয়নি। তাই এক্ষেত্রে তাদের এই অবস্থাকেই বিবাদ বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। (তাফসীরে মারিফুল কুরআন, ৪/১৮৭)
সেসময় মুসলমানগণ আল্লাহ তা‘আলার নিকট নিজেদের সংখ্যা স্বল্পতা, যুদ্ধাস্ত্রের অপ্রতুলতা এবং শত্রুবাহিনীর সংখ্যাধিক্যের ফরিয়াদ করলে আল্লাহ তা‘আলা জানিয়ে দেন, আমি তোমাদের এমন এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করবো, যারা যুদ্ধের ময়দানে ধারাবাহিকভাবে নামবে। উল্লিখিত আয়াতসমূহে এসব বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনশ’ তের জন সাহাবীকে নিয়ে কয়েক মনযিল পথ অতিক্রম করে বদরের নিকটবর্তী এক স্থানে পৌঁছলেন। সেখানে পৌঁছে আবু সুফিয়ানের কাফেলার সংবাদ নেওয়ার জন্য দুই ব্যক্তিকে পাঠালেন। গুপ্তচরদ্বয় এই সংবাদ নিয়ে এলেন যে, মুসলিমদের পিছু ধাওয়ার সংবাদ পেয়ে আবু সুফিয়ান সমুদ্রসৈকতের পথ ধরে মক্কায় পৌঁছে গেছে আর মক্কা থেকে এক হাজার সৈন্যের এক বাহিনী মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মদীনার দিকে আসছে।
এভাবে শেষ পর্যন্ত মক্কার কাফেরদের সাথে যুদ্ধ অবধারিত হয়ে যায়। পূর্বপ্রস্তুতি না থাকা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসার ও মুহাজির সাহাবায়ে কেরামের সাথে মশওয়ারা করে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
মুসলিমদের পূর্বেই মক্কার মুশরিকবাহিনী বদর নামক স্থানে পৌঁছে তুলনামূলক উঁচু ও শক্ত স্থানে শিবির স্থাপন করলো। পানির কূপগুলো তাদের কাছাকাছি ছিল। মুসলিম ফৌজ সেখানে পৌঁছে তুলনামূলক নিম্মভূমিতে শিবির স্থাপনে বাধ্য হলো। অবশ্য মুসলিম ফৌজ প্রথমে যেখানে শিবির স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল, হযরত হুবাব ইবনুল মুনযির রা. এর পরামর্শে সেখান থেকে আরেকটু এগিয়ে মুশরিক বাহিনীর দখলকৃত দুই-একটা কূপ ছিনিয়ে নিয়ে শিবির স্থাপন করলো।
শিবির স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর হযরত সাদ বিন মুয়ায রা. বললেন, আল্লাহর রাসূল, আমাদের মন চায়, আমরা আপনার জন্য নিরাপদ কোন স্থানে একটি ঝুপড়ি তৈরি করে দিই, যেখানে আপনি অবস্থান করবেন এবং আপনার বাহন-জন্তুও তার আশপাশে থাকবে। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুমতি দিলেন। ঝুপড়ি তৈরি করা হলো। হযরত আবুবকর সিদ্দিক রা. ছাড়া সেখানে অন্য কারো প্রবেশের অনুমতি ছিল না। হযরত মুয়ায রা. নাঙ্গা তরবারি হাতে ঝুপড়ির দরজায় পাহারায় নিযুক্ত হন।
যুদ্ধের পূর্বের রাত। তিনশ’ তের জন অস্ত্রহীন মুজাহিদের মোকাবেলায় এক হাজার সশস্ত্র কাফের প্রস্তত। রণাঙ্গনের শক্ত ও চলাচলের জন্য অধিক উপযোগী স্থানটাও শত্রুসেনাদের দখলে। নিজেদের শিবির বালুময় নরম ভূমির উপর, যেখানে চলাচল অত্যন্ত কষ্টকর। স্বভাবতই মুসলমানগণ অত্যন্ত পেরেশান। কাউকে তো শয়তান এই ওয়াসওয়াসাও দিল যে, তোমরা নিজেদের হকের উপর প্রতিষ্ঠিত মনে করো। অথচ এই নিশুতি রাতে আরাম করার পরিবর্তে তাহাজ্জুদসহ অন্যান্য ইবাদতে লিপ্ত রয়েছ, তা সত্ত্বেও দুশমনের অবস্থা সর্বদিক দিয়ে তোমাদের তুলনায় অনেক ভাল।
পেরেশানীর কারণে কারো ঘুম আসছিল না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা নিজ রহমতে সবার উপর ঘুম চাপিয়ে দিলেন। তাই ঘুমাতে না চাওয়া সত্ত্বেও তারা ঘুমাতে বাধ্য হয়েছিলেন। হযরত আলী রা. বলেন, গাযওয়ায়ে বদরের রাতে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত আমাদের প্রত্যেকেই ঘুমিয়ে ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারারাত তাহাজ্জুদে মশগুল ছিলেন। (তাফসীরে মারিফুল কুরআন, ৪/১৯৫)
যুদ্ধের ময়দানের এমন ঘুম বা তন্দ্রার ব্যাপারে হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, ‘যুদ্ধের ময়দানে তন্দ্রা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ আসে। আর নামাযের মধ্যে তন্দ্রা আসে শয়তানের পক্ষ থেকে।’ (তাফসীরে মারিফুল কুরআন, ৪/১৯৫)
ঐ রাতে মুজাহিদদের জন্য আরেকটি নিয়ামত এই ছিল যে, মুসলিমদের অনুকূলে বৃষ্টি বর্ষিত হয়। এমন বৃষ্টি, যা একদিকে যেমন রণাঙ্গনের নকশা পাল্টে দেয়, অন্যদিকে তার বরকতে মুসলিম ফৌজের অন্তর থেকে সব ধরনের শয়তানি ওয়াসওয়াসা দূরীভূত হয়। সেই বৃষ্টি শত্রু শিবিরে খুব বেশি পরিমাণে হয়। এতে তাদের শক্ত ভূমি কর্দমাক্ত হয়ে চলাফেরা করা দুঃসাধ্য হয়ে যায়। অপরদিকে মুসলিম শিবিরে অল্প পরিমাণে বৃষ্টি হয়। যার ফলে বালু জমে গিয়ে চলাফেরা খুব সহজ হয়ে যায়।
এসব নিয়ামতের কথা আল্লাহ তা‘আলা নিম্মোক্ত আয়াতে উল্লেখ করেছেন,
اِذْ یُغَشِّیْكُمُ النُّعَاسَ اَمَنَۃً مِّنْهُ وَیُنَزِّلُ عَلَیْكُمْ مِّنَ السَّمَآءِ مَآءً لِّیُطَهِّرَكُمْ بِهٖ وَیُذْهِبَ عَنْكُمْ رِجْزَ الشَّیْطٰنِ وَلِیَرْبِطَ عَلٰی قُلُوْبِكُمْ وَیُثَبِّتَ بِهِ الْاَقْدَامَ ○
স্মরণ করো, যখন তিনি তার পক্ষ থেকে প্রশান্তিস্বরূপ তোমাদের তন্দ্রাচ্ছন্ন করেন এবং আকাশ থেকে তোমাদের উপর পানি নাযিল করেন, যেন তার মাধ্যমে তোমাদের পবিত্র করেন এবং তোমাদের থেকে শয়তানের নাপাকি (কুমন্ত্রণা) দূর করে দেন, আর তোমাদের অন্তরে দৃঢ়তা তৈরি করেন এবং তার মাধ্যমে তোমাদের পা স্থির করে দেন। (সূরা আনফাল, আয়াত:১১)
এর পরবর্তী আয়াতে আরেকটি নিয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা মুসলিমদের উহুদ যুদ্ধের সময়ও দেওয়া হয়েছিল। তা হলো, যুদ্ধের ময়দানে ফেরেশতাদের মাধ্যমে মুসলিমদের সাহায্য প্রদান। আল্লাহ তা‘আলা বদর যুদ্ধে মুজাহিদদের সাহায্যের জন্য পাঠানো ফেরেশতাদের সম্পর্কে বলেন,
اِذْ یُوْحِیْ رَبُّکَ اِلَی الْمَلٰٓئِکَۃِ اَنِّیْ مَعَكُمْ فَثَبِّتُوا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا ؕ سَاَلْقِیْ فِیْ قُلُوْبِ الَّذِیْنَ کَفَرُوا الرُّعْبَ فَاضْرِبُوْا فَوْقَ الْاَعْنَاقِ وَاضْرِبُوْا مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ ○
স্মরণ করুন, যখন আপনার প্রতিপালক ফেরেশতাদের ওহীর মাধ্যমে হুকুম দিলেন, আমি তোমাদের সাথে আছি, কাজেই তোমরা মুমিনদের দৃঢ়পদ রাখো। আমি অবশ্যই কাফেরদের মনে ভীতি সঞ্চার করবো। সুতরাং তোমরা তাদের ঘাড়ের উপর আঘাত করো এবং তাদের মধ্য থেকে আঙুলের জোড়াসমূহে আঘাত করো। (সূরা আনফাল, আয়াত:১২)
এখানে ফেরেশতাদের দুটি দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এক. মুসলিমদের সাহস বৃদ্ধি করে ময়দানে দৃঢ় রাখা। দুই. কিতালে অংশগ্রহণ করা। ফেরেশতাগণ এ উভয় কাজই সুচারুরূপে আনজাম দিয়েছিলেন।
এই যুদ্ধ মূলত কুফর ও ইসলামের মধ্যকার যুদ্ধ ছিল। কাফেরদের আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরোধিতাই এ যুদ্ধের মূল কারণ ছিল। সে জন্য এ যুদ্ধের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে, যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরোধিতা করে, তাদের পরিণাম তেমন শোচনীয়ই হয়ে থাকে, যেমনটি মক্কার কাফেরদের হয়েছিল। পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সেদিকে ইঙ্গিত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
ذٰلِکَ بِاَنَّهُمْ شَآقُّوا اللهَ وَرَسُوْلَهٗ ۚ وَمَنْ یُّشَاقِقِ اللهَ وَرَسُوْلَهٗ فَاِنَّ اللهَ شَدِیْدُ الْعِقَابِ○ ذٰلِكُمْ فَذُوْقُوْهُ وَ اَنَّ لِلْکٰفِرِیْنَ عَذَابَ النَّارِ○
তা এ জন্য যে, তারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছে। আর যে আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরোধিতায় লিপ্ত হয়, নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠিন আযাবদানকারী। সুতরাং এর মজা ভোগ করো। নিশ্চয়ই কাফেরদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের আযাব। (সূরা আনফাল, আয়াত:১৩-১৪)
সকালবেলা উভয়দল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। টিলার আড়াল থেকে কুরাইশ সৈন্যরা বের হয়ে এলো। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সহস্রাধিক কুরাইশ সৈন্য রণাঙ্গনে সদম্ভে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেল। লৌহবর্মে আচ্ছাদিত শতাধিক অশ্বারোহী সেনাপতির হুকুমের প্রতীক্ষা করতে লাগলো। সেনাপতি ও কবিরা কুরাইশ জোয়ানদের মুসলিম মুজাহিদদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে লাগলো।
অপরপক্ষে মুসলিমদের মাত্র ৩১৩ জন পদাতিক মুজাহিদ ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে ময়দানের অপরপ্রান্তে সমবেত। অস্ত্র ও বাহ্যিক সরঞ্জামের দিক দিয়েও তারা অত্যন্ত দুর্বল। তবু তারা ভীত নন। কারণ, আল্লাহ তা‘আলার উপর তাদের অটল বিশ্বাস হলো, আল্লাহ তাদের অবশ্যই জয়ী করবেন। আল্লাহর সাহায্য তাদের সাথে আছে। আল্লাহর উপর এ বিশ্বাস ও ভরসাই তাদের মূল শক্তি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কাছে দু‘আ করলেন, আয় আল্লাহ, বিজয়ের যে ওয়াদা আপনি আমার সাথে করেছেন, তা আজ পূর্ণ করুন। দু‘আ শেষে জিবরাইল আলাইহিস সালামের পরামর্শে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন মুষ্টি বালু ও কংকর নিয়ে কাফেরদের ডানে-বায়ে ও মধ্যখানে নিক্ষেপ করলেন। আল্লাহ তা‘আলা নিজ কুদরতে বালুর কণাগুলো কাফেরদের চোখে ঢুকিয়ে দিলেন। এ ঘটনার বর্ণনা নিম্মোক্ত আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
وَمَا رَمَیْتَ اِذْ رَمَیْتَ وَلٰکِنَّ اللهَ رَمٰی ۚ
(হে নবী,) আপনি যখন (মাটি) নিক্ষেপ করেছেন, তখন তা আপনি নিক্ষেপ করেননি, বরং আল্লাহ নিক্ষেপ করেছেন। (সূরা আনফাল, আয়াত:১৭)চোখে বালুকণা ঢুকায় শত্রু সেনারা ভড়কে গিয়ে শোরগোল শুরু করে দিল। এ সুযোগে মুজাহিদগণ শত্রুবাহিনীর উপর ব্যাপক হামলা শুরু করেন। ফেরেশতাগণও মুজাহিদদের সাথে যোগ দিলেন। শত্রু সেনাদের বাহিনী প্রধান আবু জাহেল সহ সত্তরজন নিহত হলো এবং সত্তরজন বন্দি হলো। অন্যরা পালিয়ে জান বাঁচালো।
কুরাইশী বাহিনী মক্কা থেকে বের হওয়ার পূর্বে উক্ত বাহিনীর প্রধান আবু জাহেল কাবা শরীফের গিলাফ ধরে দু‘আ করেছিল। দু‘আর মধ্যে সে বলেছিল, ‘আয় আল্লাহ, দুই লশকরের মধ্যে যারা শ্রেষ্ঠ, হেদায়েতপ্রাপ্ত, ভদ্র এবং যাদের ধর্ম উত্তম, তাদের বিজয় দান করুন।’
আবু জাহেল মনে করেছিল, মুসলিমদের তুলনায় তারাই সবদিক দিয়ে উত্তম। তাই সে হক ও বাতিলের মধ্যে ফায়সালার দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলার উপর ন্যস্ত করলো। সে ভেবেছিল, যেহেতু তারা সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাই বিজয় তাদেরই হবে। আল্লাহর তা‘আলার কাছে হক ও বাতিলের মধ্যে ফায়সালার সিদ্ধান্ত প্রার্থনার উক্ত ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন,
اِنْ تَسْتَفْتِحُوْا فَقَدْ جَآءَكُمُ الْفَتْحُ ۚ وَ اِنْ تَنْتَهُوْا فَهُوَ خَیْرٌ لَّكُمْ ۚ وَ اِنْ تَعُوْدُوْا نَعُدْ ۚ وَلَنْ تُغْنِیَ عَنْكُمْ فِئَتُكُمْ شَیْئًا وَّلَوْ کَثُرَتْ ۙ وَ اَنَّ اللهَ مَعَ الْمُؤْمِنِیْنَ○
(হে কাফেররা,) যদি তোমরা মীমাংসা কামনা করো, তবে নিঃসন্দেহে মীমাংসা তোমাদের নিকট এসে গেছে। এখন যদি তোমরা নিবৃত্ত হও, তবে তা তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। আর যদি পুনরাবৃত্তি করো, তা হলে আমরাও পুনরাবৃত্তি করবো। তোমাদের দল তোমাদের কোন কাজে আসবে না, তা যত বেশিই হোক। জেনে রেখো, আল্লাহ মুমিনদের সাথে আছেন। (সূরা আনফাল, আয়াত:১৯)
উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সত্য-মিথ্যার মীমাংসা নির্ণয় করে দিয়েছেন- ঈমানদারদের পথই হলো সত্য পথ এবং কাফেরদের পথ হলো মিথ্যা। তাই আল্লাহ তা‘আলা ঈমানদের সাথে আছেন। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাদের বিজয়ী করবেন, কাফেরদের দলবল যত বেশিই হোক। অতএব, কাফেররা সর্বশক্তি নিয়োগ করেও দুনিয়ার বুক থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনীত দীন ইসলাম নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না। বরং ইসলামের নূরকে আল্লাহ তা‘আলা পূর্ণতায় পৌঁছাবেন।
বদর যুদ্ধের এই অভাবনীয় ফল লাভের মধ্যে যেমনিভাবে কাফেরদের জন্য শিক্ষা রয়েছে, তেমনি মুমিনদের জন্য রয়েছে উপদেশ। তা হলো, মুমিনদের বিজয়ের জন্য সেনাবাহিনীর সংখ্যার আধিক্য কিংবা অস্ত্রশস্ত্রের চাকচিক্য শর্ত নয়, বরং মুমিনদের বিজয়ের জন্য শর্ত হলো, তাদের খাঁটি মুমিন হতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَا تَهِنُوْا وَلَا تَحْزَنُوْا وَاَنْتُمُ الْاَعْلَوْنَ اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِیْنَ○
হীনম্মন্য হয়ো না এবং পেরেশানী করো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাকো। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত:১৩৯)
এ আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, যতদিন মুসলিম উম্মাহ আল্লাহ তা‘আলার খাঁটি ঈমান ধারণ করে তার উপর তাওয়াক্কুল করবে, ততদিন তারা বিজয়ী হবে। তখন কাফেরদের পারমাণবিক বোমাও মুসলিমদের পরাজিত করতে পারবে না। কাফের-বেদীনদের মোকাবেলায় মুসলিম বাহিনীর বিজয় অর্জনের এটাই চাবিকাঠি।