শিশু ‘ঈসা ‘আলাইহিস সালামের নবী হওয়ার ঘোষণা
এ অবস্থায় মারিয়াম ‘আলাইহাস সালাম অত্যন্ত অসহায় হয়ে পড়লেন। তিনি নিজে কথাগুলো কাউকে বুঝাতে পারছেন না। কেননা, আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে তিনি আজ কোন মানুষের সাথে কথা না বলার সাওমের মান্নত করেছেন। আর নির্জনে গিয়ে যে তিনি আশ্রয় নিবেন, সে পরিস্থিতিও নেই। সবাই তাকে ঘিরে ধরেছে। তবে এ অবস্থায় তিনি বিচলিত হলেন না। ফেরেশতার বাণীর মাধ্যমে আল্লাহর উপর তার তাওয়াক্কুল ও ভরসা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাকে এ অপবাদ থেকে মুক্ত করে তার পবিত্রতা সবার সামনে সুস্পষ্ট করে দিবেন। এ আত্মবিশ্বাস ও তাওয়াক্কুল নিয়ে তিনি প্রথমত ফেরেশতার বাতলানো নির্দেশনা অনুযায়ী নিজের কথা না বলার রোযার মান্নতের কথা সম্প্রদায়ের লোকদের ইশারায় বুঝালেন। এরপর তিনি শিশু ‘ঈসা ‘আলাইহিস সালামের দিকে হাত দ্বারা ইঙ্গিত করলেন। অর্থাৎ এ শিশু সন্তানের সাথে আপনার কথা বলুন। এ সন্তানই আপনাদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে দেবে।
তখন লোকেরা বললো, আমরা তার সাথে কেমন করে কথা বলবো? সে তো কোলের শিশু! তুমি কি আমাদের সাথে ঠাট্টা করছো? এমন সময় দুধের শিশু ‘ঈসা ‘আলাইহিস সালাম বলে উঠলেন,
اِنِّیْ عَبْدُ اللهِ اٰتٰنِیَ الْکِتٰبَ وَجَعَلَنِیْ نَبِیًّا ○ وَّ جَعَلَنِیْ مُبٰرَكًا اَیْنَ مَا كُنْتُ ۪ وَ اَوْصٰنِیْ بِالصَّلٰوۃِ وَ الزَّکٰوۃِ مَا دُمْتُ حَیًّا ○ وَّ بَرًّۢا بِوَالِدَتِیْ ۫ وَلَمْ یَجْعَلْنِیْ جَبَّارًا شَقِیًّا ○ وَالسَّلٰمُ عَلَیَّ یَوْمَ وُلِدْتُّ وَ یَوْمَ اَمُوْتُ وَ یَوْمَ اُبْعَثُ حَیًّا○
নিশ্চয় আমি আল্লাহর বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। যেখানেই আমি থাকি না কেন, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। যতদিন আমি বেঁচে থাকবো, ততদিন আমাকে নামায এবং যাকাত আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর আমাকে আমার মাতার প্রতি অনুগত করেছেন। তিনি আমাকে উদ্ধত ও হতভাগ্য বানাননি। আমার প্রতি সালাম, যেদিন আমি জন্ম গ্রহণ করেছি, যেদিন আমার মৃত্যু হবে এবং যেদিন আমি জীবিত অবস্থায় উত্থিত হবো। (সূরা মারিয়াম, আয়াত, ৩০-৩৩)
‘ঈসা ‘আলাইহিস সালামের কৈশোর
পবিত্র কুরআনে হযরত ‘ঈসা ‘আলাইহিস সালামের শৈশবের কথাই শুধু বর্ণনা করা হয়েছে। তার কৈশোরের কোন ঘটনা কুরআন শরীফে আলোচিত হয়নি। তাই বিভিন্ন ইসরাঈলী রেওয়ায়েতের আলোকে নিম্নে কিছু বিষয় উল্লেখ করা হলো।
ইসরাঈলী রেওয়ায়েতের বিখ্যাত বর্ণনাকারী ওহাব ইবনে মুনাব্বিহ রহ. থেকে যে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে এবং যার বর্ণনা মথির ইঞ্জিলেও আছে। সেখানে এ ঘটনাটিও রয়েছে যে, যখন হযরত ‘ঈসা ‘আলাইহিস সালাম ভূমিষ্ঠ হলেন, সে রাতে পারস্যের বাদশা আসমানে একটি অভিনব উজ্জ্বল নক্ষত্রের উদয় দেখতে পেলেন এবং ভয় পেয়ে গেলেন। বাদশা তার দরবারের জ্যোতিষী মন্ডলীকে সেসম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা বললেন, এ নক্ষত্রের উদয় একজন মহামানবের জন্ম লাভের সুসংবাদ বহন করে, যিনি শামদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। তখন বাদশা স্বর্ণ ও মূল্যবান দ্রব্যসমূহের উপঢৌকন দিয়ে এক প্রতিনিধিদল শামদেশে প্রেরণ করলেন। উদ্দেশ্য হলো, তারা সেখানে গমনপূর্বক সেই মর্যাদাশালী নবজাতক শিশুর জন্মগ্রহণ সম্পর্কিত যাবতীয় ঘটনা ও অবস্থা জেনে আসবেন।
এ প্রতিনিধিদল যখন শামদেশে পৌঁছে সেখানের বাদশাকে (হিরোদিয়াসকে) তাদের আগমনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করে নবজাতক শিশুর কথা বললেন, তখন বাদশা অন্যদের জিজ্ঞাসা করে বাইতুল মাকদিসে সে সময় হযরত ‘ঈসা ‘আলাইহিস সালামের এর জন্মের কথা জানতে পারলেন। যেহেতু ‘ঈসা ‘আলাইহিস সালাম মায়ের কোলেই কথা বলা আরম্ভ করেছিলেন, তাই তার খবর ছড়িয়ে পরেছিল।
তখন বাদশা আগত প্রতিনিধিদের সাথে নিজের পক্ষ থেকে কিছু লোক প্রেরণ করলেন। উদ্দেশ্য ছিল, তার খোঁজ খবর নিয়ে রাখা এবং প্রতিনিধিদল চলে গেলে তাকে হত্যা করা। এরা সবাই হযরত মারিয়ামের নিকট পৌঁছলেন, এবং প্রতিনিধিদল তাদের আনিত হাদিয়া দিয়ে নিজ দেশে ফিরে গেলেন।
ইতোমধ্যে মারিয়ামকে কেউ সংবাদ দিল যে, মনে হচ্ছে শামের বাদশার অভিপ্রায় খারাপ, এবং সে তার লোকদের মাধ্যমে শিশুটিকে হত্যা করতে চেষ্টা করছে। এই পরামর্শ শুনে হযরত মারিয়াম ‘আলাইহাস সালাম শিশু ‘ঈসাকে মিসরে নিয়ে গেলেন, এবং সেখানে তারা বারো বছর অবস্থান করেন। এবং সেখানে তার ছোট বয়সেই অনেক কারামাত প্রকাশ পায়। (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ২/৮০-৮১ মাকতাবা আব্বাস আহমাদ আল-বাজ)
‘ঈসা ‘আলাইহিস সালামের নবুওয়্যাত লাভ
হযরত ‘ঈসা ‘আলাইহিস সালামের নবুওয়্যাতের পূর্বে বনী ইসরাইল সবধরনের পাপাচারে লিপ্ত ছিল। ব্যক্তিগত ও সামাজিক সবধরনের অনাচারে আক্রান্ত ছিল। অন্যায়-অপকর্ম তাদের অস্থিমজ্জায় মিশে গিয়েছিল।
ইবাদত ও আকীদা উভয় দিক থেকে ভ্রান্তির শিকার হয়েছিল বনী ইসরাইল। এমনকি নিজ সম্প্রদায়ের পথপ্রদর্শক নবীগণকে হত্যা করতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করতো না। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে কারীমে নিম্নোক্ত আয়াতে তাদের কুফর, অন্যায়-অনাচার ও নবীগণকে হত্যা করার মতো জঘন্য কার্যকলাপের কথা তুলে ধরেছেন,
فَبِمَا نَقْضِهِمْ مِّيثَاقَهُمْ وَكُفْرِهِم بَاٰيَاتِ اللّٰهِ وَقَتْلِهِمُ الْاَنْبِيَاءَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَّقَوْلِهِمْ قُلُوْبُنَا غُلْفٌ بَلْ طَبَعَ اللّٰهُ عَلَيْهَا بِكُفْرِهِمْ فَلَا يُؤْمِنُوْنَ اِلَّا قَلِيْلًا○
এবং তারা লা’নতগ্রস্ত হয়েছিল, এজন্য যে, তারা নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে, আল্লাহর আয়াতসমূহ অস্বীকার করেছে, নবীগণকে হত্যা করেছে এবং এই উক্তি করেছে যে, আমাদের অন্তরের উপর পর্দা লাগানো রয়েছে। অথচ বাস্তবতা হলো, তাদের কুফরের কারণে আল্লাহ তা‘আলা তাদের অন্তরে মোহর করে দিয়েছেন। এ জন্য তারা অল্প কিছু বিষয় ছাড়া (অধিকাংশ বিষয়েই) ঈমান আনে না। (সূরা নিসা, আয়াত:১৫৫)
কয়েক আয়াত পর আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,
فَبِظُلْمٍ مِّنَ الَّذِيْنَ هَادُوْا حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ طَيِّبَاتٍ اُحِلَّتْ لَهُمْ وَبِصَدِّهِمْ عَنْ سَبِيْلِ اللّٰهِ كَثِيْرًا○ وَاَخْذِهِمُ الرِّبَا وَقَدْ نُهُوْا عَنْهُ وَاَكْلِهِمْ اَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَاَعْتَدْنَا لِلْكَافِرِيْنَ مِنْهُمْ عَذَابًا اَلِيْمًا ○
ইহুদীদের সীমালংঘনের কারণে আমি তাদের উপর এমন কিছু উৎকৃষ্ট বস্তু হারাম করে দিই, যা পূর্বে তাদের জন্য হালাল করা হয়েছিল এবং এ কারণে যে, তারা মানুষকে আল্লাহর পথে আসতে অত্যাধিক বাধা দিত আর তারা সুদ খেত, অথচ তাদের তা খেতে নিষেধ করা হয়েছিল এবং তারা মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করতো। তাদের মধ্যে যারা কাফের, আমি তাদের জন্য যন্ত্রণাকর শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছি। (সূরা নিসা, আয়াত:১৬০-১৬১)
অপর আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেন,
اِنَّ الَّذِيْنَ يَكْفُرُوْنَ بِاٰيَاتِ اللّٰهِ وَيَقْتُلُوْنَ النَّبِيِّيْنَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَّيَقْتُلُوْنَ الَّذِيْنَ يَاْمُرُوْنَ بِالْقِسْطِ مِنَ النَّاسِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ اَلِيْمٍ ○
যারা আল্লাহর আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করে, নবীদের অন্যায়ভাবে হত্যা করে এবং মানুষের মধ্যে যারা ইনসাফের নির্দেশ দেয় তাদেরকেও হত্যা করে, তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ দাও। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত:২১)