বাইতুল্লার চাবি গ্রহণ ও তাতে প্রবেশ
এরপর নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসমান ইবনে তালহা যিনি বাইতুল্লাহর চাবি হেফাজতের দায়িত্বে ছিলেন, তার কাছে থেকে চাবি নিয়ে বাইতুল্লায় প্রবেশ করেন। (তাবারানী কাবীর, হা. নং ৮৩৯৫; যাদুল মা‘আদ, ৩:৩৫৮)
কাবা অভ্যন্তরের মূর্তি অপসারণ
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjyrC3N_YwD7CjCSt0g9oYAetVnbCnM-tQexTtJVX17074G2ivOfltFwCd76_6KLsLqZXrTTANxCn2UlY5aiNbpHOBJ-8bazDyRzHbjpbSoxRzYz9yUU8hbMxUsxUADbKUBWBHAKWi5694/s640-rw/sirat16-01.png)
কাবার অভ্যন্তরে কিছু ছবি ছিলো দেয়ালে অঙ্কিত আর কিছু ছিলো ভাস্কর্য বা মূর্তির আকারে। কাবার আশেপাশের মূর্তি অপসারণের আগে নবীজী যখন ‘বাতহা’ অবস্থান করছিলেন, তখনই সাহাবাদেরকে কাবার অভ্যন্তরে থাকা মূর্তিসমূহ বের করার এবং স্তম্ভে ও দেয়ালে অঙ্কিত ছবিহসমূহ মুছে ফেলার নির্দেশ প্রদান করেন।
তবে মোছার পরও কিছু প্রতিকৃতির ছাপ রয়ে গিয়েছিলো। যেগুলো সহজে অপসারণ করা যাচ্ছিলো না। নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কাবার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন, তখন নিজে এবং সাহাবাদের মাধ্যমে সেই রয়ে যাওয়া ছবিগুলো পানি, মাটি ও জাফরানের মাধ্যমে মুছে ফেলেন। (ফাতহুল বারী, ৭:৬৫৪)
হযরত জাবের রা. বলেন নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবা ঘরে প্রবেশের পূর্বে ‘বাতহা’ স্থানে থাকাকালীন উমর রা. কে নির্দেশ দিলেন, যেন তিনি কাবার অভ্যন্তরে থাকা সকল ছবি মিটিয়ে দেন। উমর রা. নির্দেশ পালন করলেন, এরপর নবীজী কাবার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। (আবু দাউদ, ৪১৫৬)
উসামা ইবনে যায়দ রা. এর বর্ণনামতে কাবার অভ্যন্তরে প্রবেশের পর নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রতিকৃতি দেখতে পেলেন, তখন আমাকে পানি আনতে বললেন, আমি এক বালতি পানি নিয়ে এলাম, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে পানি দ্বারা সে প্রতিকৃতি মুছতে লাগলেন। আর বলতে লাগলেন,
«قَاتَلَ اللهُ قَوْمًا يُصَوِّرُونَ مَا لَا يَخْلُقُونَ»
“আল্লাহ তা‘আলা ধ্বংস করুন ঐ সকল লোককে, যারা এমন বস্তুর প্রতিকৃতি তৈরি করে, যারা কোন কিছুর মধ্যে প্রাণ দানে সক্ষম নয়!” (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হা. নং ২৫৭২২)
হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর বর্ণনামতে কাবার অভ্যন্তরের ছবিগুলোর মধ্যে হযরত ইবরাহীম আ. ও মারইয়াম আ. এর ছবি ছিল। (অপর বর্ণনামতে ইসমাইল আ. এর ছবিও ছিলো।) নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবরাহীম আ. ও মারইয়াম আ. এর ছবি দেখে বললেন, এঁরা (ইবরাহীম আ. ও মারইয়াম আ.) তো (আল্লাহর এ বিধান) শুনেছেন যে, ফেরেশতারা সে গৃহে প্রবেশ করেন না, যাতে কোনো চিত্র থাকে। (অর্থাৎ ছবির ব্যাপারে তাঁরা কখনও সম্মত থাকতে পারেন না।) (বুখারী শরীফ, হা. নং ৩৩৫১)
ইসমাইল আ. এর পরিবর্তে ইবরাহীম আ. যে জান্নাতী দুম্বাটি কুরবানী করেছিলেন, তার দুটি শিং কাবার অভ্যন্তরে ঝুলানো ছিলো। ফাতহে মক্কার দিন নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবার অভ্যন্তর হতে বের হওয়ার পর কাবা ঘরের চাবি রক্ষক উসমান ইবনে তালহা কে ডেকে বললেন,
انِّي كُنْتُ رَايْتُ قَرْنَيِ الْكَبْشِ حِينَ دَخَلْتُ الْبَيْتَ، فَنَسِيتُ انْ امُرَكَ انْ تُخَمِّرَهُمَا، فَخَمِّرْهُمَا فَانَّهُ لَا يَنْبَغِي انْ يَكُونَ فِي الْبَيْتِ شَيْءٌ يَشْغَلُ الْمُصَلِّيَ
‘বাইতুল্লায় প্রবেশের সময় আমি তোমাকে দুম্বার শিং দুটো ঢেকে দেওয়ার আদেশ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমি তা ভুলে গিয়েছি। সেগুলো ঢেকে দিও, কেননা ঘরে এমন কোনো বস্তু থাকা উচিত নয়, যা নামাযীর মনোযোগ বিনষ্ট করে!’ (মুসনাদে আহমাদ, হা. নং ১৬৬৩৭)
একটি বানোয়াট বর্ণনা
আযরাকী রহ. (মৃত্যু ২৫০ হি.) তার কিতাব ‘আখবারু মক্কা’ (প্রকাশনা: দারুল আন্দালুস, বৈরুত) গ্রন্থে কাবা ঘরের অভ্যন্তরে মূর্তি ভাঙা প্রসঙ্গে একটি বর্ণনা এনেছেন। যাতে রয়েছে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবার অভ্যন্তরে প্রতিকৃতি অপসারণের সময় সব প্রতিকৃতিই মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দান করেন, তবে কেবল ঈসা আ. ও মারইয়াম আ. এর প্রতিকৃতি না মিটিয়ে রেখে দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। (আখবারু মক্কা, ১:১৬৮-১৬৯)
আযরকী রহ. -এর এ বর্ণনাটি মুহাদ্দিসীনে কেরামের দৃষ্টিতে ‘মুনকার’ (চরম আপত্তিকর) এবং অগ্রহণযোগ্য।
‘মতন’ মুনকার হওয়া প্রসঙ্গ
কাবা ঘরের অভ্যন্তরের এবং আশেপাশের মূর্তি ভাঙার বিষয়ে আমরা ইতোপূর্বে যে হাদীসগুলো উল্লেখ করেছি, সে সবগুলো বর্ণনার সনদ গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের। পক্ষান্তরে আযরকী রহ. এর বর্ণনাটি ঐ সকল বর্ণনার পরিপন্থী হওয়ায় গ্রহণযোগ্য নয়। উপরন্তু তা শরী‘আতের মানশা ও রুচিরও বিপরীত। কেননা, যেখানে ছবি নির্মাণের কারণে সর্বোচ্চ শাস্তির কথা এসেছে, এবং নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে তিনশত ষাটটি মূর্তি ভাঙলেন, এমনকি কাবায় ঢোকার আগেই উমর রা. কে পাঠালেন অভ্যন্তরের মূর্তি অপসারণের জন্য, নিজ হাতে পানি দ্বারা অঙ্কিত ছবি মুছলেন, সেখানে এটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈসা আ. ও মারইয়াম আ. এর ছবি রেখে দেবেন? অথচ বুখারী শরীফের এর বর্ণনামতে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম খোদ মারইয়াম আ. এর ছবির উপরও আপত্তি করেছিলেন! (বুখারী শরীফ, হা. নং ৩৩৫১)
সারকথা হলো, ফাতহে মক্কার সময় কাবার অভ্যন্তরে মারইয়াম আ. এর ছবি থাকার কথাটি যদিও সঠিক কিন্তু সে ছবি অপসারণ না করার যে বর্ণনা রয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট বর্ণনা। বরং অন্যান্য সহীহ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন অন্য সব ছবি অপসারণ করেছিলেন, তেমনি মারইয়াম আ. এর ছবিও অপসারণ করেছিলেন।
দুঃখজনক কথা হলো, ২০০৮ সালে ঢাকা বিমানবন্দরের অদূরে হাজী ক্যাম্পের সামনে থেকে যখন লালন ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা হলো, তখন এর প্রতিবাদে বাংলাদেশের প্রয়াত একজন খ্যাতিমান কথা সাহিত্যিক দৈনিক প্রথম আলোতে (২৭ অক্টোবর ২০০৮ ঈ.সোমবার) ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করতে গিয়ে এই বানোয়াট বর্ণনাটি উদ্ধৃত করে এ কথা বুঝাবার অপপ্রয়াস চালিয়েছিলেন যে, ইসলামে ভাস্কর্য সংস্কৃতি স্বীকৃত। দীন ও শরী‘আতের মেযায ও রুচির বিপরীতে গিয়ে তিনি কেবল অনাধিকার চর্চার দোষেই দুষ্ট হয়েছেন, তা নয়; বরং কাবা ঘরের মূর্তিভাঙ্গা সংক্রান্ত সহীহ বর্ণনাসমূহ এড়িয়ে ‘একটি বানোয়াট বর্ণনা’ তুলে এনেছেন।
অথচ মুহাদ্দেসীনে কেরামের দৃষ্টিতে উল্লিখিত বর্ণনাটি গ্রহণযোগ্য না হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট। সুতরাং এ বর্ণনা নিয়ে কোন বিভ্রান্তির সুযোগ নেই।
কাবার অভ্যন্তরে নবীজীর নামায আদায় ও তাকবীর প্রদান
নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইতুল্লায় প্রবেশের পর প্রথমত অভ্যন্তরের প্রতিকৃতিসমূহের রয়ে যাওয়া ছাপ অপসারণ করেন। এরপর সেখানে নামায আদায় করেন এবং প্রত্যেক প্রান্তে তাকবীর বলেন। (যাদুল মা‘আদ, ৩:৩৫৮)
নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উসামা ইবনে যায়দ রা. বেলাল রা. ও বাইতুল্লার চাবি রক্ষক উসমান ইবনে তালহা এ তিনজনকে নিয়ে বাইতুল্লায় প্রবেশ করেন। দরজা দিয়ে প্রবেশ করে সোজা পশ্চিম দেয়ালের দিকে এগিয়ে যান। পশ্চিম দেয়াল থেকে তিন হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে ডানদিকে দু’স্তম্ভ , বামদিকে এক স্তম্ভ এবং পেছন দিকে তিন স্তম্ভ রেখে দু’রাকা‘আত নামায আদায় করেন। বাইতুল্লাহ সে সময়ে ছয় স্তম্ভ বিশিষ্ট ছিলো। (বুখারী শরীফ, হা. নং ৩৯৭, ৫০৪; মুসনাদে আহমাদ, হা. নং ৫০৬৫)
ইবনে আব্বাস রা. বলেন, বাইতুল্লায় প্রবেশের পর নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রত্যেক প্রান্তে তাকবীর বলেন। (বুখারী শরীফ, হা. নং ৪২৮৮)
ঐহিহাসিক খুতবা : ক্ষমা ও উদারতার সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত
নামায শেষ করে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বাহিরে আসেন তো দেখতে পান যে, কুরাইশরা তাদের ব্যাপারে নবীজীর সিদ্ধান্ত জানার জন্য অপেক্ষা করছে।
নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইতুল্লার দরজায় দাঁড়িয়ে গেলেন। সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে একটি খুতবা পড়লেন। যাতে সর্বপ্রথম তিনি মক্কা বিজয়ের উপর আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করলেন। কিছু আহকাম বয়ান করলেন এবং যারা তাকে দীর্ঘ দশ বছর অবর্ণনীয় নির্যাতন করেছিলো, সেই কাফের কুরাইশদের ব্যপারে তাঁর ক্ষমার সিদ্ধান্তের ঘোষণাও দিলেন।
এ ছিলো এক ঐতিহাসিক ক্ষমা। কেননা, কোষমুক্ত তরবারীর নির্দয় আঘাতে দীর্ঘদিনের জুলুম-নির্যাতন, অন্যায়-অবিচারের প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিরোধ যেখানে ছিল না, সেখানে সবকিছু ভুলে গিয়ে ক্ষমা ও উদারতার এমন উন্মুক্ত ঘোষণা তো কেবল সর্বোত্তম মানবের পক্ষেই সম্ভব ছিল।
ঐতিহাসিক সে খুতবায় নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَا الَهَ الَّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، صَدَقَ وَعْدَهُ، وَنَصَرَ عَبْدَهُ، وَهَزَمَ الْاحْزَابَ وَحْدَهُ، الَا كُلُّ مَاثُرَةٍ اوْ دَمٍ اوْ مَالٍ يُدَّعَى فَهُوَ تَحْتَ قَدَمَيَّ هَاتَيْنِ الَّا سَدَانَةَ الْبَيْتِ وَسِقَايَةَ الْحَاجِّ، الَا وَقَتِيلُ الْخَطَا شِبْهِ الْعَمْدِ بِالسَّوْطِ وَالْعَصَا، فَفِيهِ الدّية مُغَلّظَة، مائَة مِنْ الْابِلِ، ارْبَعُونَ مِنْهَا فِي بُطُونِهَا اوْلَادُهَا... (رواه احمد وابن اسحاق)
(وفي رواية ابن اسحاق) يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ، انَّ اللهَ قَدْ اذْهَبَ عَنْكُمْ نَخْوَةَ الْجَاهِلِيَّةِ، وَتَعَظُّمَهَا بِالْابَاءِ، النَّاسُ مِنْ ادَمَ، وَادَمُ مِنْ تُرَابٍ، ثُمَّ تَلَا هَذِهِ الْايَةَ: يَا ايُّهَا النَّاسُ انَّا خَلَقْناكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَانْثى، وَجَعَلْناكُمْ شُعُوبا وَقَبائِلَ لِتَعارَفُوا، انَّ اكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ اتْقاكُمْ ... الْايَةَ كُلَّهَا.
(وفي رواية البيهقي):مَا تَقُولُونَ وَمَا تَظُنُّونَ "؟ قَالُوا: نَقُولُ: ابْنُ اخٍ وَابْنُ عَمٍّ حَلِيمٌ رَحِيمٌ. قَالَ: وَقَالُوا ذَلِكَ ثَلَاثًا , فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: " اقُولُ كَمَا قَالَ يُوسُفُ: لَا تَثْرِيبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ يَغْفِرُ اللهُ لَكُمْ وَهُوَ ارْحَمُ الرَّاحِمِينَ. قَالَ: فَخَرَجُوا كَانَّمَا نُشِرُوا مِنَ الْقُبُورِ فَدَخَلُوا فِي الْاسْلَامِ.
এক-অদ্বিতীয় আল্লাহ তা‘আলা ব্যতিত কোনো মা‘বুদ নেই। তিনি তাঁর (বিজয়ের) প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে দেখিয়েছেন। তার ‘বান্দা’ কে সাহায্য করেছেন এবং কাফেরদের সম্মিলিত বাহিনীকে একাই পরাজিত করেছেন।
শুনে রাখো! (জাহেলী যুগের) সমস্ত অভ্যাস ও জান-মালের দাবি আমার পায়ের নিচে (অর্থাৎ তা বাতিল করা হলো), তবে বাইতুল্লার দাড়োয়ানী এবং হাজীদেরকে যমযমের পানি পান করানোর অভ্যাসটি পূর্ববৎ বহাল থাকবে।
শুনে রাখো! যে ব্যক্তি কারো চাবুক কিংবা লাঠির আঘাতে ভুলবশতঃ নিহত হবে, তার রক্তপণ হলো একশত উট, যার মধ্যে চল্লিশটি উটনী হতে হবে গর্ভবতী।
হে কুরাইশ লোকসকল! আল্লাহ তা‘আলা জাহেলী যুগের অহমিকাবোধ ও পূর্বপুরুষের নামে অহংকারবোধ বাতিল করে দিয়েছেন। সকল মানুষ এক আদম এর সন্তান, আর আদম আ. হলেন মাটির তৈরি।
এরপর নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনে কারীমের এ আয়াত পড়লেন,
یٰۤایُّهَا النَّاسُ انَّا خَلَقْنٰكُمْ مِّنْ ذَکَرٍ وَّ انْثٰی وَ جَعَلْنٰكُمْ شُعُوْبًا وَّ قَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوْا ؕ انَّ اكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ اتْقٰكُمْ ؕ انَّ اللهَ عَلِیْمٌ خَبِیْرٌ ○
(আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন), (হে মানুষ!) আমি তোমাদের সকলকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পারো। প্রকৃতপক্ষে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান সেই, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি মুত্তাকী। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছু সম্পর্কে অবহিত। (সূরা হুজরাত, আয়াত:১৩)
এরপর নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বললেন,..‘হে কুরাইশ লোকসকল! আজকে আমার কাছ থেকে তোমরা কেমন আচরণ আশা করো? (কুরাইশরা যদিও নিজেদের অপরাধের ব্যাপারে সচেতন ছিলো, তদুপরি নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদারতার অবগতিও তাদের যথেষ্ট ছিলো। কাজেই তারা বললো-) আপনি আমাদের একজন (সম্ভ্রান্ত) ভাইয়ের সন্তান, এবং সম্ভ্রান্ত চাচার সন্তান। আপনি সহনশীল এবং দয়ালু!
নবীজী তাদেরকে বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে সেটাই বলবো, যেটা ইউসুফ আ. তার (অপরাধী) ভাইদেরকে (ক্ষমা প্রদানকালে) বলেছিলেন,
لَا تَثْرِيْبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ يَغْفِرُ اللهُ لَكُمْ وَهُوَ ارْحَمُ الرَّاحِمِيْنَ○
‘আজ তোমাদের উপর কোনো অভিযোগ আনা হবে না। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সকল দয়ালু অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দয়ালু।’ (মুসরানাদে আহমাদ, হা. নং ১৫৩৮৮; সীরাতে ইবনে হিশাম, ৪:৬০)
নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরে লোকেরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো।
হত্যার দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত কতিপয় কাফের
নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেও কাফেরদের মধ্যে এমন কিছু দাগী আসামী রয়ে গিয়েছিলো, যারা ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি সাধনে কাফেরদের মধ্যে সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখেছিলো। তাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া ‘ইনসাফ’ পরিপন্থি ছিলো। কাজেই সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার পরেও নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুনির্দিষ্ট এ সকল কাফেরদেরকে হারামের যেখানেই পাওয়া যায়-এমনকি যদি তারা বাইতুল্লার গিলাফও ধরে থাকে, তবে সেখানেই তাদেরকে হত্যা করার হুকুম দান করেন।
উল্লেখ্য, মক্কা বিজয়ের দিন আল্লাহ তা‘আলা তার নবীর শানে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হারামের সীমানায় হত্যাকার্যের নিষিদ্ধতার হুকুম উঠিয়ে নিয়েছিলেন। যার বর্ণনা সামনে আসছে।
হত্যার দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত এ সকল কাফেরদের অধিকাংশই ইসলাম গ্রহণ করে নেওয়ায় নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে মাফ করে দিয়েছিলেন। তারা হলেন,
১. আব্দুল্লাহ ইবনে খতল। যাকে আবু বারযা রা. হত্যা করেন।
২. আব্দুল্লাহ ইবনে আবী সারাহ। হত্যা দণ্ডাদেশ পাওয়ার পর যে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলো। হযরত উসমান রা. এর সুপারিশে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মাফ করে দেন।
৩. ইকরামা ইবনে আবু জাহল। যে ইয়ামানের দিকে পালিয়ে গিয়েছিলো। তার স্ত্রী উম্মে হাকীম যে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলো, নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামর কাছ থেকে স্বামীর নিরাপত্তা নিয়ে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। দরবারে রিসালাতে পৌঁছে ইকরামা ইসলাম গ্রহণ করেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকেও মাফ করে দেন।
৪. হুয়াইরিস ইবনে নুকাইদ। যে মক্কার জীবনে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সীমাহীন কষ্ট দিয়েছিলো। হযরত আলী রা. তাকে হত্যা করেন।
৫. হাব্বার ইবনে আসওয়াদ। মক্কার জীবনে মুসলমানদের উপর নির্যাতনে সে অগ্রণী ছিলো। নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা হযরত যয়নব রা. যখন হিজরত করেন, তখন পথিমধ্যে এই হাব্বার নবীজীর কন্যাকে উট থেকে ফেলে দিয়েছিলো। সে আঘাতেই পরবর্তীতে যয়নব রা. ইন্তেকাল করেন। এতদ্বসত্ত্বেও ফাতহে মক্কার দিনে হাব্বার যখন ইসলাম গ্রহণ করলো তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মাফ করে দিলেন।
৬.৭. ইবনে খতল এর দু’বাঁদি, যাদের নাম ছিলো ফারতানা ও ক্বরীনা। তাদের একজনকে হত্যা করা হয়। আর আরেকজন ইসলাম গ্রহণ করে নেয়।
৮. সারা। সে ইসলাম গ্রহণ করে নেয়।
৯. হারেস ইবনে তলাতিল। হযরত আলী রা. তাকে হত্যা করেন।
১০. কা‘ব বিন যুহায়র। সে ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছিলো।
১১. ওয়াহশী। যে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চাচা হযরত হামজা রা. কে ওহুদের যুদ্ধে নির্মমভাবে শহীদ করেছিলো। সেও ইসলাম গ্রহণ করে নিয়েছিলো। নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকেও মাফ করে দেন।
১২. হিন্দ বিনতে উতবা (আবু সুফিয়ানের স্ত্রী।) সেও ইসলাম গ্রহণ করে নেওয়ায় নবীজী তাকে মাফ করে দেন।
১৩. আরনাব। ইবনে খতলের বাঁদি। তাকে হত্যা করা হয়।
১৪. উম্মে সা‘দ। তাকে হত্যা করা হয়।
এই সর্বমোট আটজন পুরুষ ও ছয়জন নারীকে হত্যার আদেশ দেয়া হয়। (ফাতহুল বারী, ৭:৬৪৮; ৪:৭২; সীরাতে মুস্তফা, ৩:৪৬)