আপনার টাকার সঠিক ব্যবহার করুন দেখুন কিভাবে!

রাসূল সা. এর জীবনি (পর্ব - ১০) খায়বারযুদ্ধের সময়কাল

এক ইহুদী নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে নিজের জানমালের নিরাপত্তার শর্তে দুর্গ বিজয়ের পথ বাতলে দেওয়ার অঙ্গীকার করলো। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নিরাপত্তা দিলেন। ইহুদী নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললো, আপনি যদি এক মাসও এ দুর্গ অবরোধ করে রাখেন তবু আপনি তা বিজয় করতে পারবেন না। (কারণ ইহুদীদের কাছে কেল্লার ভিতরে যথেষ্ট খাদ্যসম্ভার মজুদ রয়েছে এবং) তারা দুর্গের বাইরে থেকে প্রবাহিত একটি নালার মাধ্যমে পানির প্রয়োজন পূরণ করে থাকে।

খায়বারযুদ্ধের সময়কাল

ইমাম মালেক রহ. ও ইবনে হাযম জহেরী রহ. এর মতে খায়বার যুদ্ধ ষষ্ঠ হিজরিতে সংঘটিত হয়। তবে ইবনে ইসহাক রহ. এর মতে তা সপ্তম হিজরিতে সংঘটিত হয়েছে। আল্লামা ইবনে হাজার রহ. ও আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. ইবনে ইসহাকের মতটিই প্রাধান্য দিয়েছেন।  অর্থাৎ ষষ্ঠ হিজরির জিলহজ্জ মাসের শেষদিকে হুদায়বিয়া হতে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর সপ্তম হিজরির মহররম মাসের শুরুর কিছুদিন পর্যন্ত মদীনায় অবস্থান করেন। অতঃপর মহররমের শেষদিকে খায়বারের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ যাত্রা করেন। 
হুদায়বিয়া হতে প্রত্যাবর্তনের পর খায়বারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার পূর্বে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতদিন মদীনায় ছিলেন, এ ব্যাপারে মতবিরোধ রয়েছে।  কারো মতে বিশদিন, কারো মতে দশদিন, আবার কারো মতে পনেরোদিন অবস্থান করেন। (ফাতহুল বারী, ৭:৫৭৬; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪:১৯৮)

খায়বার যুদ্ধের সৈন্যদল

ইবনে ইসহাক রহ. হযরত জাবের রা. এর সূত্রে বর্ণনা করেন, খায়বারে মুজাহিদদের সংখ্যা হুদায়বিয়ার মুসলিমদের সমপরিমাণ ছিল। অর্থাৎ ১৪০০। তাদের মধ্যে দুইশ’ অশ্বারোহী এবং বারোশ’ ছিল পদাতিক।  (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪:১৭০, ২২০)
এর বিপরীতে হযরত মুজাম্মা ইবনে জারিয়া রা.-এর সূত্রে বর্ণিত, খায়বারের যুদ্ধে মুসলিমদের সংখ্যা ছিল ষোল শ’। এর মধ্যে পদাতিক চৌদ্দশ’এবং অশ্বারোহী দুইশ’ছিল। (আবু দাউদ, হাদীস নং ৩০১০) এর বিপরীতে খায়বারের ইহুদীদের সংখ্যা ছিল দশ হাজার। [শরহুয যুরকানী ৩: ২৪৩; (সীরাতে মুস্তফা, ২:৪০৯)]


নবীজীর স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ

খায়বার যুদ্ধে গমনের পূর্বে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় তার স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করে যান। ইবনে হিশাম রহ. এর মতে নিয়োগকৃত গভর্নর ছিলেন নুমায়লা ইবনে আবদুল্লাহ লাইসী রা.।  তবে হযরত আবু হুরায়রা রা. এর সূত্রে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত সিবা ইবনে উরফুতা গিফারী রা. কে স্থলাভিষিক্ত করেন। হাফেয ইবনে হাজার রহ. এ মতটি সঠিক বলে উল্লেখ করেছেন। 
এ সফরে ‘উম্মুল মুমিনীনে’র মধ্য হতে হযরত উম্মে সালামা রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলেন। (মুসনাদে আহমাদ:৮৫৫২; মুসতাদরাকে হাকীম:২২৪১; সিরাতুন্নবী:আল্লামা শিবলী নুমানী ও আল্লামা সুলাইমান নদভী রহ. ১:২৯৫)


জিহাদের পথে রওয়ানা এবং শাহাদাতের সুসংবাদ

জিহাদের পথে আত্মোৎসর্গকারী সাহাবীদের গমন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তারা ছিলেন আল্লাহর উপর ঈমান ও ইখলাসে পরিপূর্ণ। প্রিয়নবীর সাথে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রণাঙ্গন ছিল তাদের জন্য জান্নাতের বাগিচা। শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে আল্লাহর প্রিয়ভাজন হওয়ার সহজতম পন্থা।
এ কারণেই নবীজীর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে যখন সাহাবা কাফেলা খায়বারের পথে যাত্রা শুরু করে তখন হযরত আমের ইবনুল আকওয়া, যিনি একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন এবং সম্পর্কে হযরত সালামা ইবনুল আকওয়ার চাচা ছিলেন, তিনি আবৃত্তি করছিলেন, 

اَللّٰهُمَّلولاأنتمااهتدينا + ولاتصدقناولاصلينا
فاغفرفداءلكماأبقينا + وثبتالأقدامإنلاقينا
وألقينسكينةعلينا + إناإذاصيحبناأبينا
وبالصياحعولواعلينا
হে আল্লাহ, যদি আপনার তাওফীক না হতো, তা হলে আমরা না সঠিক পথের দিশা পেতাম, না নামায পড়তে কিংবা সদকা করতে পারতাম। 
আপনি আমাদের জীবনের সকল গুনাহ মাফ করে দিন এবং শত্রুর মোকাবেলায় আমাদের দৃঢ়পদ রাখুন। (আপনার সন্তুষ্টির তরে আমাদের জীবন উৎসর্গিত হোক।)
আর আমাদের উপর সাকীনা অবতীর্ণ করুন। যদি কাফেররা আমাদের কুফরের দিকে ধাবিত করতে বদ্ধপরিকর হয় তবু আমরা তা প্রত্যাখ্যান করব। 
যারা আমাদেরকে তাদের সাহায্যের জন্য আহ্বান করবে তারা আমাদের উপর আস্থা নিয়েই আহ্বান করবে। (কাশফুল বারী:খায়বার যুদ্ধ অধ্যায়)
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমেরের এ কবিতা শুনে বললেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা তোমার প্রতি রহম করুন’। অপর বর্ণনায় এসেছে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাকে ক্ষমা করে দিন’। 
বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত সালামা রা. বলেন, (জিহাদের ময়দানে) নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কারো জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করতেন তখন সে অবশ্যই শহীদ হতো!
আমেরের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষমা প্রার্থনার অর্থ বুঝতে পেরে হযরত উমর রা. বললেন, হে আল্লাহর নবী, আমেরের জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে গেল।  কতই-না ভালো হতো যদি আমরা আমেরের বীরত্ব দ্বারা আরো কিছুদিন উপকৃত হতে পারতাম!’
হযরত আমের এ যুদ্ধেই শহীদ হয়ে যান। (বুখারী শরীফ, হা. নং ৪১৯৬; মুসলিম, হা. নং ১৮০৭)


খায়বারের উপকণ্ঠে

শাহাদাতের পিয়াসী সাহাবীদের পবিত্র এই জামা‘আতকে নিয়েই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম খায়বারের উপকণ্ঠে উপনীত হন।
ইবনে ইসহাক রহ, বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম খায়বারের নিকটে পৌঁছে ইহুদী এবং গাতফান গোত্রের অবস্থানস্থলের মধ্যবর্তী ‘রজী’ নামক স্থানে অবস্থান গ্রহণ করেন। যেন ইহুদীদের মিত্র ‘গাতফানের’ লোকেরা ইহুদীদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে না পারে।
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ যুদ্ধকৌশল সফল হয় এবং গাতফান গোত্রের লোকেরা নিজেদের পরিবার-পরিজন ও সহায়-সম্পদের চিন্তায় ইহুদীদের সহযোগিতা থেকে বিরত থাকে। (ফাতহুল বারী, ৭:৫৮০)


নবীজীর বাহন

খায়বারের বসতিতে প্রবেশকালে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাহন কী ছিল? এ ব্যাপারে ‘মুসতাদরাকে হাকিমে’ হযরত আনাস রা. থেকে এবং সুনানে আবু দাউদে হযরত আবদুল্লাহ বিন উমর রা. থেকে বর্ণিত হাদীস দুটি দ্বারা জানা যায়, এ দিন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাহন ছিল গাধা, যার লাগাম খেজুর গাছের আঁশের রশি দ্বারা তৈরীকৃত ছিল। (মুসতাদরাকে হাকীম, হা. নং ৩৭৩৪; সুনানে আবু দাউদ, হা. নং ১২২৬)
তবে বুখারী শরীফে হযরত আনাস রা. এর অপর এক বর্ণনার আলোকে আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. এর মত হলো, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিন ঘোড়ায় আরোহন করেছিলেন। তবে দুর্গ অবরোধকালে কোন দিন হয়তো গাধায় আরোহন করে থাকবেন। যা অন্য বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে। (আল বিদায়া ওয়াননিহায়া, ৪:২০২)


জনপদে প্রবেশের আদব শিক্ষাদান

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খায়বারের নিকটবর্তী হলেন তখন সেখানে প্রবেশের পূর্বে এ দু‘আ পড়লেন,

اَللّٰهُمَّرَبَّالسَّمَاوَاتِالسَّبْعِ وَمَااَظْلَلْنَوَرَبَّالْاَرْضِيْنَالسَّبْعِوَمَااَقْلَلْنَوَرَبَّالشَّيَاطِيْنَوَمَااَضْلَلْنَوَرَبَّالرِّيَا حِوَمَاذَرَيْنَفَاِنَّانَسْاَلُكَمِنْخَيْرِهَذِهِالْقَرْيَةِوَخَيْرَاَهْلِهَا وَخَيْرَمَافِيْهَاوَاَعُوْذُبِكَمِنْشَرِّهَاوَشَرِّاَهْلِهَاوَشَرِّمَافِيْهَا
‘হে আল্লাহ, হে সাত আসমান সাত জমিন এবং এ দুইয়ের মধ্যবর্তী সবকিছুর রব, হে ঐ পবিত্র সত্তা, যিনি পথভ্রষ্টকারী শয়তানের রব এবং শয়তান যাদের বিভ্রান্ত করে, তাদের রব, হে ঐ মহান সত্তা, যিনি বাতাসসমূহের এবং বাতাস যাতে প্রবাহিত হয় সেসব কিছুর রব, আমরা আপনার কাছে এ জনপদের এবং জনপদবাসীর কল্যাণ কামনা করছি। এবং এ জনপদ, তার অধিবাসী ও তার সবকিছুর অনিষ্ট থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি’। (আস সুনানুল কুবরা লিন নাসায়ী, হা. নং ১০৩০৪)


আক্রমণের সূচনা এবং প্রিয়নবীর যবানে বিজয়ের সুসংবাদ

নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহুদীদের উপর আক্রমণ এমন অবস্থায় করলেন যে, তারা সকালে তাদের ফসলি জমিতে কাজ করার উদ্দেশ্যে জমি চাষের বিভিন্ন সরঞ্জাম নিয়ে বের হচ্ছিল।  তারা আমাদের দেখে বলে উঠলো,

محمد! والله،محمد! والخميس!!
হায়! খোদার কসম, মুহাম্মাদ তো তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে আক্রমণ করে বসেছে! এ কথা বলে তারা তাদের দুর্গের ভিতর আশ্রয় নিল। 
 নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাদের দেখলেন তখন বললেন,
اللهأكبر،اللهأكبر،خربت خيبر،إناإذانزلنابساحةقومفساءصباحالمنذرين
‘আল্লাহু আকবার! আল্লাহু আকবার!! খায়বার ধ্বংস হবে। আমরা যখন কোন জনপদের আঙিনায় অবতরণ করি তখন যাদের সতর্ক করা হয়েছে তাদের প্রভাত হবে অতি মন্দ’।  (বুখারী শরীফ হা. নং ৬১০, ২৯৯১)
‘খায়বার ধ্বংস হবে’ এ কথাটির ব্যাখ্যা হলো, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন, আল্লাহ তা‘আলা খায়বারের ইহুদীদের তার হাতে পরাজিত করবেন। (ফাতহুল বারী, ৭:৫৮১; সিরাতে হালবিয়্যাহ, ৩:১২৩)


খায়বারের দুর্গসমূহ

খায়বারে ইহুদীদের ছোট-বড় বহুসংখ্যক দুর্গ ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেগুলো ধারাবাহিকভাবে বিজয় করেন।  এ সকল বিজিত দুর্গের সংখ্যা, নাম ও বিজয়ের ধারাবাহিকতার ব্যাপারে ঐতিহাসিকগণের একাধিক মত রয়েছে। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিকগণ যে সকল দুর্গের নাম উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে ছয়টির নাম এখানে উল্লেখ করা হলো।
১. নাইম দুর্গ।২. কামুস দুর্গ।৩. সা‘দ বিন মুয়ায দুর্গ।
৪. কুল্লা দুর্গ। এটি গনীমত বণ্টনের সময় হযরত যুবায়ের রা. এর হাতে আসায় তাকে ‘যুবায়ের দুর্গ’ ও বলা হয়। 
৫. ও ৬. ওয়াতীহ ও সুলালিম। এই দুর্গ দুটি দুর্গের সরদার ‘ইবনে আবুল হুকাইক-এর দুর্গ’ নামে প্রসিদ্ধ ছিল।  সবশেষে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুর্গ দুটি জয় করেন। 
কোন কোন ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন, কুল্লা দুর্গ জয় করার পর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোট ছোট আরো কিছু দুর্গ জয় করেন।  আল্লামা ওয়াকিদী রহ. এক্ষেত্রে ‘উবাই দুর্গ’-এর নাম উল্লেখ করেছেন।  আল্লামা যুরকানী রহ. উবাই দুর্গ-এর সাথে ‘বারী দুর্গ’-এর নামও উল্লেখ করেছেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪:২০৯-২১১, ২১৫-২১৬; কাশফুল বারী, খায়বার যুদ্ধ অধ্যায়, সীরাতে মুস্তফা, ২:৪১২)

নাইম দুর্গ বিজয়:

সর্বপ্রথম নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দুর্গটি জয় করেন তা হল নাইম দুর্গ। এ দুর্গ বিজয়কালে সাহাবী হযরত মাহমুদ ইবনে সালামা রা. শহীদ হন। আল্লামা হালাবী রহ. বলেন, যুদ্ধ করতে করতে যখন তিনি ক্লান্ত হয়ে নাইম দুর্গের এক কোনায় দেয়ালের ছায়ায় বিশ্রামের জন্য বসে পড়েন, তখন উপর থেকে পাথরের চাক্কি ফেলে তাকে শহীদ করে দেওয়া হয়। কারো মতে, মারহাব নামক ইহুদী আর কারো মতে, কিনানা ইবনে রবী পাথর নিক্ষেপ করে তাকে শহীদ করে। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪:২০৪; সীরাতে মুস্তফা, ২:৪১২) 

কামুস দুর্গ বিজয়:

নাইম দুর্গের পর মুসলিমরা কামুস দুর্গের দিকে অগ্রসর হলো। খায়বারের অন্যান্য সকল দুর্গের তুলনায় কামুস ছিল অধিক মজবুত এবং সুরক্ষিত। প্রখ্যাত ইহুদী বীর পাহলোয়ান মারহাব এখানেই ছিল। সহস্র যোদ্ধার সমান মনে করা হতো তাকে। প্রায় বিশদিন পর্যন্ত মুসলিমরা এ দুর্গ অবরোধ করে রাখেন। (ফাতহুল বারী, ৭:৫৮১)
খায়বার (-এর কামুস দুর্গ) অবরোধ করার পর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর রা. ও হযরত উমর রা. কে ক্রমান্বয়ে তা বিজয় করার জন্য পাঠালেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার ফায়সালা না থাকায় তারা উভয়েই অকৃতকার্য হয়ে ফিরে আসেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

انيدافعاللواءغداالىرجليحبهاللهورسولهويحباللهورسولهلايرجعحتىيفتحله
আগামীকাল আমি এমন একজনকে পতাকা দিব, যাকে আল্লাহ এবং তার রাসূল ভালোবাসেন এবং সেও আল্লাহ এবং তার রাসূলকে ভালোবাসে! আর সে ঐ কেল্লা ফাতাহ না করে ফিরে আসবে না। (বুখারী, মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ)
মনে মনে প্রত্যেক সাহাবীই চাচ্ছিলেন ‘বিজয় নিশান’ এর সৌভাগ্যের অধিকারী হতে। কিন্তু সকালে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী রা. কে ডাকলেন। আলী রা. চক্ষুরোগে আক্রান্ত ছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার চোখে থুথু লাগিয়ে দিলেন এবং তার জন্য দু‘আ করলেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু‘আর বরকতে আলী রা. তৎক্ষণাৎ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন। এরপর আর কোন দিন তিনি চক্ষু রোগে আক্রান্ত হননি। (ফাতহুল বারী, ৭:৫৮৮)
এরপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রা. কে পতাকা দিলেন। আলী রা. বললেন,
افاقتلهمحتىيكونوامثلنا؟
কাফেররা আমাদের ন্যায় মুসলমান হওয়ার আগ পর্যন্ত কি আমি তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ চালিয়ে যাবো?’
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
انفذعلىرسلكحتىتنزلبسحاتهمثمادعهمالىالاسلامواخبرهمبمايجبعليهمفواللهلانيهدىاللهبكرجلاخيرلكمنحمرالنعم
ধীরে-সুস্থে চলো হে আলী, তাদের মুখোমুখি হলে প্রথমতঃ তাদের ইসলাম গ্রহণের দিকে আহ্বান করো এবং তাদের আল্লাহর বিধান সম্পর্কে অবগত করো। আল্লাহর শপথ, আল্লাহ তা‘আলা তোমার মাধ্যমে কাউকে হেদায়েত দিবেন, এটা তোমার জন্য লাল উট প্রাপ্তির চেয়েও উত্তম।

মারহাবের সাথে যুদ্ধ:

দুর্গ অবরোধ করার পর দুর্গের প্রখ্যাত ইহুদী বীর মারহাব দুর্গ থেকে বের হয়ে তার সাথে একক যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য মুসলিমদের প্রতি রণহুঙ্কার ছাড়তে লাগলো। হযরত আমের ইবনুল আকওয়া তার মোকাবেলায় অবতীর্ণ হলেন। কিন্তু দ্বৈত লড়াইয়ের এক পর্যায়ে ঘটনাক্রমে হযরত আমেরের একটি আঘাত ব্যর্থ হয়ে তাকেই শহীদ করে দিল। লোকেরা যখন এটাকে আত্মহত্যা মনে করে হযরত আমেরের আমলের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে গেল, তখন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সন্দেহ দূর করে বললেন,

كذبمنقالهانلهلاجرين-وجمعبيناصبعه-انهلجاهدمجاهدقلعربىمشىبهامثله
যারা তার আমল বাতিল হওয়ার কথা বলছে তারা ভুল করছে। (এরপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাতের দু‘আঙুল একত্র করে ইশারা করে বললেন,) সে তো দু’সওয়াবের অধিকারী। নিশ্চয় সে অত্যন্ত কষ্টসহিষ্ণু মুজাহিদ। তার মতো আরব অনেক কমই আল্লাহর জমিনে রয়েছে!
এরপর পাহলোয়ান মারহাব রণসঙ্গীত গেয়ে গেয়ে ময়দানে হযরত আলী রা. এর মোকাবেলায় অবতীর্ণ হলো।
قَدْعَلِمَتْخَيْبَرُاَنِّيمَرْحَبُ ... شَاكِيالسِّلَاحِبَطَلٌمُجَرَّباِذَاالْحُرُوبُاَقْبَلَتْتَلَهَّب
খায়বারবাসীরা জানে, আমি হলাম মারহাব। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রণাঙ্গনে যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত, অভিজ্ঞ সৈনিক। 
হযরত আলী রা. সঙ্গীতের মাধ্যমেই তার জবাব দিয়ে অগ্রসর হলেন,
اَنَاالَّذِيسَمَّتْنِياَمِّيحَيْدَرَهْ ... كَلَيْثِغَابَاتٍكَرِيهِالْمَنْظَرَهْاَوفِيهِمُبِالصَّاعِكَيْلَالسَّنْدَرَهْ
আমি ঐ বীর, যাকে তার মা নাম রেখেছে ‘হায়দার’ (সিংহ), যা বনের হিংস্র সিংহের মতোই সাক্ষাত মৃত্যু! প্রতিপক্ষের প্রতি আমার আঘাত অত্যন্ত নির্মম হয়ে থাকে!’
এরপর আলী রা. মারহাবের কথিত বীরত্ব মুহূর্তেই ইতিহাসে পরিণত করলেন। এক আঘাতেই মারহাব দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। খায়বার দুর্গের পতনও নিশ্চিত হলো। (মুসনাদে আহমাদ, ২২৯৯৩; বুখারী, ৩০০৯, ৪১৯৬; মুসলিম, ১৮০৭)
এ বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, মারহাবকে হত্যা করেন হযরত আলী রা.। কিন্তু হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. এর বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায়, মারহাবের মোকাবেলা করার জন্য সাহাবী মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অনুমতি চাইলেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনুমতি দিলেন এবং তার জন্য দু‘আ করলেন, ‘আয় আল্লাহ, তুমি তাকে সাহায্য কর।’
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু‘আর বরকতে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা মারহাবকে হত্যা করে ফেললেন। (মুসনাদে আহমাদ, হা.নং ১৫১৩৪)
ইমাম ইবনুল আসির রহ. মারহাবের হত্যাকাণ্ড হযরত আলী রা. এর হাতে হওয়ার মতটি অধিকাংশ আলেমের মত বলে উল্লেখ করেছেন। তবে ইমাম ইবনে আবদুল বার রহ. এর মত হলো, মারহাবকে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা হত্যা করেন। 
ইমামুল মাগাযী আল্লামা ওয়াকিদী রহ. এ দু’বর্ণনার মাঝে সমন্বয়সাধন করে বলেন, মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা মারহাবকে তার পা কেটে আহত করেছিল। আর পরবর্তী সময়ে আলী রা. মারহাবের মাথা কেটে তাকে হত্যা করেন। (ফাতহুল বারী, ৭:৫৯০; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪:২০৪-২০৬)

আলী রা.-এর বীরত্ব সংক্রান্ত একটি অগ্রহণযোগ্য বর্ণনা:

কামুস দুর্গ বিজয়কালে হযরত আলী রা. এর বীরত্ব সম্পর্কে ইমাম বায়হাকী রহ. দুটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন।
একটি হযরত আবু রাফে রা. থেকে, যাতে উল্লেখ হয়েছে, কামুসদুর্গ জয়ে য্দ্ধুরত অবস্থায় হযরত আলী রা. এর ঢাল ভেঙে গেলে তিনি দুর্গের দরজা উঠিয়ে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। পরবর্তী সময় আটজন জোয়ানের পক্ষেও সে দরজা বহন করা সম্ভব হয়নি।
দ্বিতীয় বর্ণনাটি হযরত জাবের রা. এর সূত্রে, যাতে এক সনদে (আটজনের পরিবর্তে) চল্লিশজন আর অন্য সনদে সত্তরজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।  (দালায়িলুন নুবুওয়াহ লিল বায়হাকী, ৪:২০৫)
কিন্তু এসব রেওয়ায়েত সনদের দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের নয়। ইমাম বায়হাকী রহ. এই দুই রেওয়ায়েতকে যয়িফ সাব্যস্ত করেছেন। এ ছাড়াও ইমাম সাখাবী রহ. ও এ বর্ণনাগুলোর অগ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে বলেন,

قلت : بلكلهاواهيةولذاانكرهبعضالعلماء
এ বর্ণনাগুলোর সবকটিই অত্যন্ত দূর্বল। এ কারণেই আলেমগণ এ ঘটনার শুদ্ধতা মেনে নেননি। (আল মাকাসিদুল হাসানাহ, পৃষ্ঠা-২২৬)
ইমাম যাহাবী রহ. হযরত জাবের রা. এর রেওয়ায়েতের অগ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে বলেন, 
هذامنكر 
এ বর্ণনাটি মুনকার পর্যায়ের। (মীযানুল ইতিদাল, ৩:১১৩)
আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. সবগুলো রেওয়ায়েতকে যয়িফ সাব্যস্ত করে হযরত আবু রাফে-এর রেওয়ায়েত সম্পর্কে বলেন, 
وفىهذاالخبرجهالةوانقطاعظاهر
এ সনদের একজন বর্ণনাকারী অজ্ঞাত এবং সনদে বিচ্ছিন্নতা রয়েছে। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪:২০৭) 

উম্মুল মুমিনীন হযরত সাফিয়া রা. প্রসঙ্গ:

হযরত সাফিয়া রা. ছিলেন ইহুদী-নেতা হুয়াই ইবনে আখতাবের মেয়ে এবং হযরত হারুন আলাইহিস সালামের বংশধর। প্রথমত তার বিয়ে হয়েছিল ইহুদী সাল্লাম ইবনে মিশকামের সাথে। তার থেকে বিচ্ছেদের পর তার বিয়ে হয় কিনানা ইবনে রবীর সাথে। 
কামুস দুর্গ বিজয় হওয়ার পর অনেক ইহুদী নারী মুসলিমদের কয়েদি হিসেবে বন্দি হয়, যাদের মধ্যে হযরত সাফিয়াও ছিলেন। হযরত দিহইয়া কালবী রা. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে একটি বাঁদী চাইলেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তার পছন্দমত একটি বাঁদী নিয়ে যেতে বললেন। হযরত দিহইয়া কালবী রা. সাফিয়াকে নিয়ে নিলেন। (বুখারী শরীফ, ২৮৯৩, ৪২১১; আবু দাউদ, ২৯৯১, ২৯৯৪, ২৯৯৭, ২৯৯৮)
হযরত সাফিয়া ইহুদী-সরদারের মেয়ে এবং হারুন আলাইহিস সালামের বংশধর হওয়ায় বিশেষ সম্মানের অধিকারী ছিলেন। বন্দি ইহুদী নারীদের মধ্যে সাফিয়ার মতো সম্মানিত কেউ ছিল না। পক্ষান্তরে সাহাবীদের মধ্যে হযরত দিহইয়া কালবী রা. এর সমপর্যায়ের অনেক সাহাবীই ছিলেন। 
সঙ্গত কারণেই জনৈক সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আপত্তি জানালেন এবং সাফিয়ার সম্মান বহাল রাখার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অনুরোধ করলেন, তিনি যেন সাফিয়াকে বিয়ে করে নেন। এ অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত দিহইয়াকে সাফিয়ার পরিবর্তে অপর একটি বাঁদি-সাফিয়ার চাচাতো বোনকে দিলেন। সম্ভবত অতিরিক্ত সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে তাকে আরো কিছু গোলাম-বাঁদি দিলেন এবং সাফিয়াকে নিজের কাছে রেখে তার যথার্থ সম্মান বহাল রাখলেন। (আবু দাউদ শরীফের এক বর্ণনায় ২৯৯৭) 
পরবর্তী সময়ে হযরত সাফিয়া রা. ইসলাম গ্রহণ করলে এবং তার স্বামী কিনানা খায়বারযুদ্ধে নিহত হলে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আযাদ করে বিয়ে করে নিলেন।
খায়বার যুদ্ধ হতে ফেরার পথে ‘সাহবা’ নামক স্থানে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে ‘হাইস’ (খেজুর, পনীর ও ঘি দ্বারা তৈরীকৃত খাবার বিশেষ) দ্বারা সাহাবীদের অলিমা খাওয়ান এবং তিন দিন সেখানে অবস্থান করেন। (ফাতহুল বারী, ৭:৫৮২-৫৯০,৫৯১; উমদাদুল ক্বারী, ১২:২১৫, ২২২)

সা‘দ বিন মুয়ায দুর্গ বিজয়:

কামুস দুর্গ বিজয় করার পর মুসলিমরা সা‘দ বিন মুয়ায দুর্গ জয় করার পথে অগ্রসর হন। খাদ্যসম্ভারের দিক থেকে এ দুর্গ ইহুদীদের সবচেয়ে বড় আশ্রয় ছিল। আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. ইবনে ইসহাক ও ওয়াকিদী রহ. থেকে বর্ণনা করেন, কতক সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে খাদ্যসংকটের অভিযোগ করলে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য দু‘আ করলেন,

اَللّٰهُمَّانكقدعرفتحالهموانليستلهمقوةوانليسبيدىشيءاعطيهماياهفافتحعليهماعظمحصونهاعنهمغنىواكثرهاطعاماوودكا
হে আল্লাহ! আপনি জানেন তাদের কোন শক্তি নেই। আর আমার কাছেও এমন কিছু নেই, যা আমি তাদের দিতে পারি। খাদ্যসম্ভারের দিক থেকে সবচেয়ে বড় দুর্গটি আপনি তাদের বিজয় করার তাওফীক দান করুন।
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ দু‘আর বরকতে খুব সহজেই সাহাবায়ে কেরাম সা‘দ বিন মুয়ায দুর্গ জয় করে নিলেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪:২১১; সীরাতে মুস্তফা, ২:৪১৫) 

কুল্লা দুর্গ বিজয়:

এরপর মুসলিমরা কুল্লা দুর্গের দিকে অগ্রসর হন। এটি একটি পাহাড়ের চূড়ায় নির্মাণ করা হয়। খায়বারের গনীমত বণ্টনের পর এ দুর্গ হযরত যুবায়ের রা. এর অংশে আসায় পরবর্তীকালে তাকে যুবায়ের কেল্লা নামে নামকরণ করা হয়। ইবনে কাসীর রহ. ইমাম ওয়াকিদীর বক্তব্য উল্লেখ করেন, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনদিন পর্যন্ত এ দুর্গ অবরোধ করে রাখেন। 

কাফের যখন দীনের সৈনিক:

এ দুর্গ অবরোধকালে আল্লাহ তা‘আলা গায়েবিভাবে মুসলিমদের সাহায্য করলেন। এক ইহুদী নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে নিজের জানমালের নিরাপত্তার শর্তে দুর্গ বিজয়ের পথ বাতলে দেওয়ার অঙ্গীকার করলো। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নিরাপত্তা দিলেন। ইহুদী নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললো, আপনি যদি এক মাসও এ দুর্গ অবরোধ করে রাখেন তবু আপনি তা বিজয় করতে পারবেন না। (কারণ ইহুদীদের কাছে কেল্লার ভিতরে যথেষ্ট খাদ্যসম্ভার মজুদ রয়েছে এবং) তারা দুর্গের বাইরে থেকে প্রবাহিত একটি নালার মাধ্যমে পানির প্রয়োজন পূরণ করে থাকে।
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সংবাদ পেয়ে বাইরে থেকে নালার পানির প্রবাহ বন্ধ করে দিলেন। ফলে দুর্গের ভেতরের ইহুদীরা বাধ্য হয়ে বের হয়ে এসে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো। দশজন ইহুদী নিহত হলো। কয়েকজন মুসলমানও শহীদ হলেন। অবশেষে কুল্লা দুর্গ মুসলিমদের পদানত হলো। এভাবেই এক কাফের ইহুদীর মাধ্যমেই আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের বিজয় দান করলেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪:২১৬)

ওয়াতিহ ও সুলালিম দুর্গ বিজয়:

কুল্লা দুর্গ বিজয়ের পর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছোট ছোট কিছু দুর্গ জয় করেন। সবশেষে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াতিহ ও সুলালিম দুর্গ জয় করেন। ইহুদীরা অন্যান্য দুর্গ থেকে পরাজিত হয়ে এ দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিল। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় ১৪দিন এ দুর্গ দুটি অবরোধ করে রাখেন। ইহুদীরা যখন নিজেদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী দেখতে পেল, তখন দুর্গ-অধিপতি ইবনে আবুল হুকাইক সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে দুর্গ থেকে নেমে এলো। হযরত ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সন্ধির প্রস্তাব দুটি শর্তে মেনে নেনঃ
• সোনা, রুপা এবং সকল যুদ্ধাস্ত্র তারা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সমর্পণ করে কেবল নিজেদের নিত্য-দিনের ব্যবহার্য্য সামগ্রী তাদের উট-ঘোড়ার বহনশক্তি পরিমাণ সাথে নিয়ে খায়বার ছেড়ে চলে যাবে। 
• উল্লিখিত কোন নিষিদ্ধ জিনিস তারা গোপন করবে না বা লুকিয়ে নিয়ে যাবে না। (আবু দাউদ, হা. নং ৩০০৬; বায়হাকী, হা. নং ১৮৩৮৭)
কিন্তু ইহুদীরা এ শর্ত রক্ষা করলো না। বরং বনু কুরাইযার নেতা হুয়াই ইবনে আখতাবের একটি সোনা-রুপার থলে লুকিয়ে ফেললো। কিন্তু এ বিশ্বাসঘাতকতার কথা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জেনে ফেললেন। যদ্দরূন সন্ধিচুক্তি ভেঙ্গে গেল। ফলে তিনি ইবনে আবুল হুকাইক এবং তার পরিবারের কয়েকজনকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। যাদের মধ্যে সাফিয়ার ইহুদী স্বামী কিনানাও ছিল এবং ইহুদীদের সন্তান ও নারীদের বন্দি করলেন। তাদের সকল সম্পদ মুসলিমদের মাঝে বণ্টন করে দিলেন। 
পরিশেষে যখন তাদের দেশান্তর করতে চাইলেন, তখন তারা আবেদন করলো যেন তাদের দেশান্তর না করে খায়বারে মুসলিমদের অধিকৃত ভূমিতে চাষাবাদের জন্য গোলাম হিসেবে রেখে দেওয়া হয়। উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক প্রদানের শর্তে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের এ অনুরোধ মেনে নিলেন। এ মর্মে আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রা. প্রতি বছর তাদের থেকে উক্ত ফসল উসুল করতেন। 
হযরত ইবনে উমর রা. বর্ণনা করেন যে, ইহুদীদের খায়বারে থেকে যাওয়ার সময়সীমার বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ ইচ্ছার উপর শর্ত আরোপ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে হযরত উমর রা. ইহুদীদের খায়বার থেকে বহিষ্কার করে ‘তাইমা’ ও ‘আরিহা’ অঞ্চলের দিকে পাঠিয়ে দেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪:২২১,২১৬,২৩৭; ফাতহুল বারী, ৭:৫৮৯-৫৯০) 
যা বর্তমানে সৌদি আরবের উত্তরপ্রান্তে ও জর্দানের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত। 
ইমামুল মাগাযী আল্লামা ওয়াকিদী রহ. এর মতে, খায়বার যুদ্ধে সর্বমোট পনেরোজন মুসলমান শহীদ হন। হাফেয ইবনে কাসীর রহ. ‘আলবিদায়া ওয়াননিহায়া’ গ্রন্থে তাদের নাম উল্লেখ করেছেন। (সীরাতে ইবনে হিশাম, ৩:৩৭৩; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪:২৩২)

Rate This Article

আমাদের রাসূল সা. এর জীবনি (পর্ব - ১০) খায়বারযুদ্ধের সময়কাল বিষয়ক লেখাটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমাদের পোষ্টটি শেয়ার করার জন্য অনুরোধ রইল।

Getting Info...

About the Author

ছোট বেলা থেকেই টেকনোলজির নিজের ভিতর অন্যরকম একটা টান অনুভব করি। যদিও কওমি মাদরাসার চার দেয়ালের ভিতরেই ছিল বসবাস। তারপরও অধম্য আগ্রহের কারনে যতটুকু শিখেছি ততটুকু ছড়িয়ে দিতে চাই সকলের মাঝে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

কুকি সম্মতি
আপনার ব্রাউজিং আরো সুন্দর রাখতে, ও আপনার করা বুকমার্ক মনে রাখতে আমাদেরকে কুকি সংরক্ষনে সম্মতি দিন।
উহু!
মনে হচ্ছে আপনার ইন্টারনেট কানেকশনে সমস্যা হয়েছে। দয়া করে ইন্টারনেট কানেকশন চেক করুন। অথবা আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।